মিথ্যা পরিচয়ে আ.লীগের কাউন্সিলর মনোনয়ন!

158

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীদের কেউ কেউ ‘ভুয়া’ সাংগঠনিক পরিচয় ব্যবহার করেছেন। মনোনয়ন পেতে দলীয় কোনো পদে না থেকেও ব্যবহার করেছেন সাংগঠনিক পরিচয়। আবার কখনো সভা-সমাবেশে যাননি এমন ব্যক্তিও পেয়েছেন মনোনয়ন। এমন কয়েকজন প্রার্থীকে নিয়ে গত দুইদিন ধরে বন্দরনগরীতে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। মিথ্যা পরিচয় দেয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগ পাঠিয়েছেন মনোনয়ন বঞ্চিতরা। যে কারণে মনোনয়নপ্রাপ্তরা প্রার্থিতা হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রার্থী মনোনয়নে শুধুমাত্র সাংগঠনিক পরিচয় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে তা কিন্তু নয়। অনেককে ব্যক্তি ইমেজের কারণেও মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে আগে অভিযোগ উঠেছিল সেগুলো যাচাই-বাছাই করেই প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে মনোনয়ন বোর্ড। এখন যে অভিযোগগুলো আসছে তা বিবেচনায় নিয়ে মনোনয়ন বোর্ড চাইলে আবারো প্রার্থী পরিবর্তন করতে পারে। তবে যাই হবে তা আমরা তাৎক্ষণিক জানিয়ে দিব।’
দলীয় সূত্র জানায়, ৩৫নং বক্সিরহাট ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর হাজী নুরুল হক। দলের কোন পদে না থেকেও মনোনয়ন পেতে নিজেকে নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিচয় দিয়েছেন। তবে নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটিতে ৬নং সিরিয়ালে একজন নুরুল হক থাকলেও তিনি কাউন্সিলর হাজী নুরুল হক নন বলে জানান নগর আওয়ামী লীগের নেতারা।
নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন পূর্বদেশকে বলেন, ‘নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে যে নুরুল হক ঠাঁই পেয়েছেন উনি হালিশহরের বাসিন্দা। এই নুরুল হক আমাদের দলের কেউ নন। তবে উনার ভাই আওয়ামী লীগ করেন, ছেলে যুবলীগ করেন। নেত্রী চাইলে যে কাউকে মনোনয়ন দিতে পারেন। তবে এভাবে মিথ্যা পরিচয় দেয়াটা উচিত হয়নি। বাকি আরো কয়েকজনের বিষয়ে আলোচনা উঠলেও এগুলো বড় ধরনের ভুল নয়।’
কাউন্সিলর মনোনয়ন বঞ্চিত ফয়েজ উল্লাহ বাহাদুর পূর্বদেশকে বলেন, ‘ভুয়া পরিচয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রতারণা করেছেন হাজী নুরুল হক। আমি নির্বাচন করলে বেঈমানি হবে। তবুও আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রীর সাথে যে প্রতারণা করা হয়েছে তার প্রতিবাদ করতে হলেও নির্বাচন করতে হবে। হাজী নুরুল হক বিএনপি করেন। ২০০০ সাল ও ২০০৫ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচন করেছিলেন।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও মোবাইল রিসিভ করেননি কাউন্সিলর হাজী নুরুল হক।
১৬নং চকবাজার ওয়ার্ডে মনোনয়ন পাওয়া বর্তমান কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হিসেবে সাংগঠনিক পরিচয় দিয়েছেন। টানা ছয়বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মনোনয়ন ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। গতকাল চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাফর আহমদ চৌধুরী প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মিন্টুর বিরুদ্ধে এমন অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘কাউন্সিলর পদে চকবাজার ওয়ার্ডে অরাজনৈতিক ব্যক্তি সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টুকে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় সমর্থন দেয়ায় দলীয় নেতাকর্মীরা বিব্রত হয়েছেন। ভুয়া রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে মিন্টু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়েছেন। এযাবৎ চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়নি। তিনি দলের সাধারণ সদস্যও ছিলেন না কখনো।’
চকবাজারের কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ যদি না করি তাহলে নিশ্চই জামায়াত। তাদের কথায় তো মনে হচ্ছে আমি প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের সাথে ছিলাম। আমি মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে থেকেই রাজনীতি করেছি। চসিকের বর্তমান মেয়র ভালো জানেন। আর যিনি সংবাদ সম্মেলন করেছেন উনি বিদ্রোহী। আমি উপদেষ্টা কিনা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক জানেন। জাফরতো এখন কোন দলীয় সভাতেই আসেন না।’
১৪ নং লালখান বাজার ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আবুল হাসনাত মো. বেলাল। সাবেক এই ছাত্রনেতা কাউন্সিলর মনোনয়ন পেতে ব্যবহার করেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য পরিচয়। তবে ২০০১ সালে গঠিত কমিটিতে আবুল হাসনাত বেলাল কোনো পদে ছিলেন না। নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহব্বায়ক এড. এইচএম জিয়াউদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমাদের কমিটি যখন হয়েছিল তখন বেলাল কমিটিতে ছিল না। পরবর্তীতে আমাদের সকল সাংগঠনিক কার্যক্রমে সে অংশ নিলেও কোন ধরনের পদ-পদবি নেই।’
২১ নং জামালখানে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য পরিচয়ে মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন। কিন্তু তিনি কোন পদে নেই বলে জানিয়েছেন জামালখান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতারা।
জামালখান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুল নাসের পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি ৩০ বছরের মাঠের কর্মী। এখন কেউ যদি দলের নাম দিয়ে প্রার্থী হয় তাহলে সেটি সুবিধার জন্য। যিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি কোন কমিটিতে নেই। উনি হয়তো আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ অভিযানে সদস্য হয়ে নিজেকে ওয়ার্ড কমিটির সদস্য পরিচয় দিচ্ছেন। আমিও নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছি।’
জামালখান ওয়ার্ডেও বর্তমান কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি জামালখান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য। আমি মুজিবাদর্শের সৈনিক। যিনি অভিযোগ দিয়েছে শুনছি উনার ছেলে কিন্তু জঙ্গি। যদিও সেগুলো আমি বলতে চাইছি না। আওয়ামী লীগ আমাকে শুধুমাত্র সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয়নি। সকল ক্যাটাগরী দেখেই মনোনয়ন দিয়েছেন। উনারা সবকিছু বলে আগে জলঘোলা করে ফেলুক, তারপর আমি জবাব দিব।’
এদিকে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়া প্রার্থীদের অধিকাংশই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে অনেকেই রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছেন। যে কারণে এবার চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর সাথে বিদ্রোহী প্রার্থীদের লড়াই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর সেটা হলেই ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো চট্টগ্রামেও অনেক প্রার্থীকে বিদ্রোহের আগুনে পুড়তে হবে।