মা তোমরা বড়ই অদ্ভুত

170

ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে নারীরা অনেক পরিচয় ধারণ করে। নারীর হাজারো রূপ থাকলেও একটি জায়গায় অভিন্ন থাকেন সৃষ্টিকর্তার এই সৃষ্টি। আর তা হল ‘মায়ের’ ভূমিকায়। পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ, সুন্দর, শ্রæতিমধুর ও স্পষ্ট কোনো শব্দ যদি থাকে সেটা কেবলই ‘মা’-ই। আজ একজন মায়ের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন ‘মা’। তাঁরই শ্রদ্ধার্তে আমার কিছু আবেগ রূপ নিয়েছে শব্দে। যে শব্দে কম্পিত হবে আমার দেখা সেই মায়ের সংগ্রামী জীবনের চম্বুক অংশ।
অল্প বয়সে বিয়ে হয় অপরাজিতার। জন্ম থেকে মিলহীন সমীকরণে বেড়ে উঠে মেয়েটি। কলেজের গÐি না পেরুতেই সংসার শুরু হয় তাঁর। বেকার স্বামীকে নিয়ে শুরু হয় নতুন সংগ্রামের গল্প। কখনও স্বামীর সাথে নিয়ে দোকানী করা, আবার কখনও ‘টেলিকমের’ ব্যবসা করিয়ে দারিদ্রতার সাথে টেক্কা দেওয়া চেষ্টা। তবে এসবের মাঝেও থামেনি অপরাজিতার পড়াশোনা। সাথে ছিল যুব উন্নয়ন থেকে কয়েক ধরনের প্রশিক্ষণ। সব নিয়ে শুরু করেন ‘কো-অপারেটিভ সমবায় সমিতি। পরিশ্রমের দরুন আসে সফলতাও। বিদায় হয় দারিদ্রতার। সংসারে আলো জ্বালিয়ে আসে দুটো সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে। তারই মাঝে অপরাজিতার চাকুরি মেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্বামী ব্যবসা দেখছেন আর তিনি চাকুরি করছেন। দিব্যি কেটে যাচ্ছিল তাদের সময়গুলো। হঠাৎ অপরাজিতার স্বামী বাইক কিনল। সেই বাইকে চড়ে ১৩ হাজার টাকার কাপড় কিনে বউ আর সন্তানকে দেখতে আসলেন শ্বশুর বাড়িতে। দেখেও গেলেন। তবে আরও কখনও ফিলে এলেন না। সড়ক দুর্ঘটনায় কেড়ে নিল স্বামীর সাথে বুনা অপরাজিতার সবকটি স্বপ্ন। এই হলো অপরাজিতার প্রথমবার হেরে যাওয়ার গল্প। বয়স তখনও পঁচিশ ছুঁইনি সদ্য বিধবা হওয়া মেয়েটির। তারপর শুরু হলো দ্বিতীয়জীবনের গল্প। সে জীবনের একটি রাত। যে রাতের গল্প মিলে যায় হাজারো মায়ের সাথে। স্বামীর সাথেই সবকিছু হারাতে হয় অপরাজিতার। সাথে কাঁধে নিয়ে চলতে হচ্ছে অপ্রত্যাশিত ঋণের বোঝা। সঙ্গী কেউ নেই। আছে শুধু স্বার্থে জর্জরিত করুণায় ভরা সম্পর্কগুলো।
সেই রাত ছিল বৃষ্টির রাত। সারাদিন ‘স্টুডেন্ট’ পড়িয়ে বাসায় ফিরেছে অপরাজিতা। ক্লান্ত আর গøানি নিয়ে সন্ধ্যায় পেরিয়ে রাত এসেছে। বৃষ্টির মাত্রারও বেড়েছে বেশ। অপরাজিতার দুই চোখের মনি ( দুই সন্তান) পড়ছিল। মাত্র ৭ হাজার টাকার বেতনের চাকুরি। থাকেন ভাড়া বাসায়। সবমিলিয়ে মাসের বিশদিন পেরুতে পারলেও শেষ দশদিন কষ্টটা খুব কাছ দেখত অপরাজিতার দুই সন্তান। ওইরাতও ছিল শেষ দশদিনের একরাত। বাসায় চাল বলতে কিছুই নেই। নেই কোনো খাবারও। তবে বিস্কুট আর মুড়ির টিনটায় দুইখানা ‘পÐ বিস্কুট’ পড়ে ছিল। বাচ্চাদের ক্ষিদে মেটাতে পানি দিয়ে বিস্কুট দিয়েছিল মা অপরাজিতা। তবে রাতের খাবার নয়। এইটুকুন খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অবুঝ হৃদয় দুইটি। ক্ষিদের জ্বালায় কান্না করার সাহসও ছিল না তাদের। কেননা ওইসময়টায় বাস্তবতার সাথে সাথে মিশতে মিশতে অবুঝ শিশুগুলো হয়ে উঠেছিল বুঝশিশুর মতন। কিন্তু মা অপরাজিতার চোখে ঘুম নেই। চোখে চল চল করে ভাসছে অবজ্ঞা, অবহেলা আর পথে পথে লুলুপ্ত চোখের রক্তাক্ত চাহনি। সাথে আরও বেদনা বাড়িয়েছে চেনা মানুষগুলোর অচেনা রূপ। বড্ড অপরিচিত মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবীটাকে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। একেকটা রাত যেন একেকটা জনম। স্বপ্নবাজ অপরাজিতা মানসিকভাবে হেরে গিয়েছে। আর সইতে পারছে না অচেনা এই দুনিয়ার জ্বালা। তাই সেইদিন রাতে শখের উড়নাটা নিয়ে চলন্ত সিলিং ফ্যান থামিয়ে ঝুলিয়ে নেয়। ফাঁসির মুখে ঝুলে পড়তেই চোখে পড়ে সন্তান দুইটির পবিত্র চেহারাগুলো। তারপর আবারও থামে। খোলা চোল আর জানাল বেয়ে আসা বৃষ্টির বাসাতে বড্ড অচেনা মনে হচ্ছিল সবকিছু। সন্তানদের ঘুমে ওষুধ খাইয়ে, তারপর নিজে ফাঁসিতে ঝুলার প্লান করে নেন অপরাজিতা। হাতে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ নিয়ে প্রথমে মেয়েটাকে ঘুম ভাঙতে গেলেই কোমল হাত দুইটি দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাকে। অপরাজিতা আর হাত দুটো সরাতে পারেনি………
এভাবে অনেক রাতেও হেরে যেতে গিয়েও হারা হয়নি অপরাজিতার। বড় ছেলেটি পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেয়ে শহরের সেরা কলেজে। নামের সাথে সংগ্রামকে পুঁজি করে তিনি আজ সফল, নাকি সার্থক ? এমন প্রশ্নের উত্তর বরাবরই শব্দশূন্যতায় ভুগবে পুরো জাহান । বৃষ্টির মতনই বিধায় নিয়েছে অসহ্য দু:খের দিনগুলো।
এটি একটি মায়ের গল্প। খুব কাছ থেকে দেখা এমন অনেক মায়ের গল্প আমার জানা। পৃথিবীর অনেক মায়েল এমন কষ্টের হাজারো রাত রয়েছে। তারা কখনও হারেনি। তবে জিতেনিও। শুধু জিতিয়েছে সন্তান নামের শেষ অবলম্বনদের………..

লেখক: প্রাবন্ধিক