মাহমুদ নোমান কবিতা বানানোর প্রবঞ্চনায় বিশ্বাসী নয়

174

মাহমুদ নোমানের কবিতা পড়ি বাক্ পত্রিকার ১০৫ তম সংখ্যায়। তার আগে সেভাবে তাঁর কবিতার সাথে পরিচয় ছিল না। নোমানের প্রথম বই “লুইজালে” এর আলোচনা প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয় – মাহমুদ নোমান তাঁর কবিতায় আশ্রিত চালাকি বা দৃপ্ত আবেগ রাখেনি। যেটুকু রয়েছে তা হল তাঁর তপোবল; শ্রীকৃষ্ণ ঠিক যেই তপোবলে উদাসীন ছিলেন সমরের নৈতিকতায়, ঠিক সেই তপোবলই তাঁর কবিতার হাতিয়ার বা একঠাসা আর্সেনাল; যার দায়বদ্ধতা শুধু নিজের অস্ত্রটুকুর প্রতি। আমদানীনীতির ওপর নয়। পারিপার্শ্বিক চেতনাবোধ যেন তার নিজস্ব আত্মীয়স্বজন। কংক্রীট ঠাসা সময়ের থেকে দূরে গ্রাম ও গ্রামের বাস্তবিক রূপই ধরা দেয় তার ফুসফুসের “লুইজালে”। যেখানে কল্পিত মৃন্ময়ের প্রতিসার আশ্রয় নেই, যা আছে তা হল নিজের মননে জড়িয়ে যাওয়া এক হুঙ্কার আর স্বপ্ন ও জেগে থাকার মাঝের সম্পর্কটুকু। মায়ের আশপাশ থেকে কখনো দূরে যেতে চায় নি,এটা অক্ষমতা নয়,কেবল দায়বন্ধন ; কেননা মাহমুদ নোমানের কবিতায় তাঁর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দের যুতসই ব্যবহার লক্ষণীয়। এইসব শব্দ নোমানের কবিতাকে সুশ্রী এবং সৌন্দর্যমÐিত করেছে শুধু নয় কবিতাকে দিয়েছে নতুনত্ব, জৌলুসতা আর অর্থময় ও গীতিময়তা। “লুইজালে” কবিতা বইয়ের নাম কবিতাটি পড়লে এইসব কথার সত্যতা উন্মোচিত হবে –
বিলের ধারের বটগাছটি আমার মা।
বাবা হয়তো লুইজাল নিয়ে
মাছ ধরতে গেছে গেছে
বোনটি প্যাঁকপ্যাক করছে
শেওলার হাডিঁতে
আমি ঝুলছি বটগাছে –
পরগাছার ইঁয়ড়ে…
– ১৩পৃ.)


উপরোক্ত কবিতাটি মাহমুদ নোমানের গ্রামের মানুষের জীবনজীবিকা, জীবনজিজ্ঞাসা খোলাসা করে দিয়েছে। অথচ বলতে পারেন ছোট্ট এই একটি কবিতায় কী নেই! এই কবিতার মাধ্যমে মাহমুদ নোমানের গ্রামে যেন এইমাত্র ঘুরে এলাম। যখন কবিতার প্রথম লাইনটি “বিলের ধারের বটগাছটি আমার মা।” কী দারুণ আশ্চর্যকথা যে, মায়েরাতো সন্তানের জন্য বটগাছ। অনড় থাকে শত দুঃখ-দুর্দশায় সন্তানের মঙ্গললাভের জন্য আর বাবা লুইজাল নিয়ে মাছ ধরতে গেছে মানে পরিবারের জন্য জীবিকার তাগিদে বাইরে গেছে এবং বোনটি প্যাঁকপ্যাঁক করছে বলায় বুঝতে পারি বোনকে হাঁসের সাথে তুলনা করেছে যে, শেওলার হাডিঁতে মানে শ্যাওলাভরা ক্ষুদ্র জলাশয়ে। এখানে ক্ষুদ্র জলাশয় বললে গীতিময়তা এমনকি কবিতার কাব্যিকতা বিনষ্ট হতো আর নতুন একটি “হাডিঁ” শব্দের ব্যবহারের নান্দনিকতায় মনটা ফ‚র্তিবাজ হয়ে গেছে। এরপরে কবি যখন নিজেকে বলছে “আমি ঝুলছি বটগাছে” মানে মায়ের সাথে পরগাছার ইঁয়ড়ে, এখানে “ইঁয়ড়ে” ও “হাডিঁ” এর মতো আরেকটি চট্টগ্রামের শব্দ এবং ইঁয়ড়ে না বলে যদি বলতো শেকড়ে তাহলে বাক্যের যে চলন এবং উপরের বাক্যগুলোর শেষসময়ের আবদার অথবা চিত্রময়তার ভাব রক্ষিত হতো না। এই একটি কবিতার কথা বলে মোটামুটি বোঝানো যায়, মাহমুদ নোমানের কাব্যজগতে কী দিতে এসেছে বা গতিপথ কোনদিকে….
যেখানে শহুরে বিষবাষ্প ঢেকে যাচ্ছে কবিতার কুয়াশাপথ সেখানে মাহমুদ নোমান এক সাদা ঘোড়া। অভিমানী ঘোড়া যাঁর কবিতার পরতে পরতে হীরক স্বচ্ছতা। ‘লুইজালে’ কবিতার বইটি এক সাধনুত্ত¡ ছাড়া কিছু নয়। আধ্যাত্মিকতার এক গভীর মর্মদহ কবিতার বেশ গভীরে প্রোথিত ; তাই মাহমুদ নোমান ‘লুইজালে’ বইটির ভূমিকার এক জায়গায় লিখেছে নিজের সম্পর্কে – “আমার মৃত্যুর শতবছর পরে হলেও আমি জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকবো….”
‘লুইজালে’ পাঠে আমার মনে হয়েছে মাহমুদ নোমান সেই ঢোঁড়াই যে জীবন অতিবাহিত করেছে প্রতিক‚লতার মধ্যে অথচ তার কবিতা মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলে যাচ্ছে – “পাথুরে মাটিতে জন্মে সমুদ্রের স্বাদ নেওয়া স্বপ্নালু চোখে মানায় না, বরং পাথর খুঁজে জল সন্ধান করতে হয়।” তবুও তার সান্দ্রতম অনুভ‚তিকে কঠোর হাতে পরাস্ত করে তার হাতেখড়ি কাব্যকে বেঁধেছেন মেরুদন্ডের অন্তিম পীড়ায়।
তাঁর কবিতায় সৃষ্টি ও সংহারের মিশ্রণ। যেমন প্রথম কবিতাটি –

পাহাড়ে নিয়তের মোমবাতি জ্বলছে
ঝাড়ের ফাঁকে চোখ গলিয়ে দেখছি
চাঁদ নেমে এসেছে

নাকের কাছাকাছি শুঁকছি এই-তো
কারো চোখের জলে,
গলে যাচ্ছে একটু একটু

সিনার বোতাম খুলে
ফের তাকাতেই
দেখি চাঁদ নেই।
চাঁদ নিয়ে কেউ কেউ বাড়ি ফিরে গেছে।

– মকসুদে তুমি ;১১ পৃ. )

কবিতার প্রথম স্তবকটিতে যেন এক সৃষ্টির প্রদীপ জ্বলছে আর শেষ স্তবকে কবি যখন বলছে দেখি চাঁদ নেই/ চাঁদ নিয়ে কেউ কেউ বাড়ি ফিরে গেছে” এখানে এক অদ্ভুত সংহার তৎক্ষণাৎ দানা বেঁধে যায়। আবার ঠিক পরের কবিতায় লিখেন –

আমি দৈনিক দুঃখকে জ্বালাই
আগরবাতির মতো

সকাল-সন্ধ্যা জ্বালাই
আর রাতে আগরবাতির গন্ধ শুঁকে
এলিয়ে পড়ি মাকড়সার জালে।
উদ্ভিন্ন যৌনতার রতিতৃপ্তির মতো

আগরবাতি নিয়ে আল্লাকে ডাকা
কিংবা কাঁদতে খুব ইচ্ছে হলে

আগরবাতির শরণাপন্ন হই
বুক চাপড়ানো দুঃখগুলো
আগরবাতির সুগন্ধিতে জিকির করে
আমার রওজার চতুর্দিকে।

– আগরবাতির কাস্টমার;১২ পৃ. )

এই কবিতাটিতে সে যেন নিজেই সমর্পিত। সে বিশ্বাস করতে চায় একজন শিল্পীর রহাড়ষাবসবহঃ -এ। বা “সধঃবৎরধষ ৎবষধঃরহম ঃড় ংঁনলবপঃ” নাড়ির যোগে। আমরা দেখতে পাই সমস্ত কবিতাগুলোতে পাঠককে ধঃধৎীরপ করা তার ধান্দা নয়। সে সেই কম্পোজার যে স্বপ্নে নতুন সুর খোঁজে আর হারিয়ে যাওয়া সরগমগুলিকে মনে রেখে এগিয়ে চলে, সবসড়ৎু রহ ফৎবধসং এর মধ্যদশায়।

প্রতিটা কবিতায় সে তীব্রতর বোধ জড়িত। যদি কোনও কবি তার কবিতায় তীব্রভাবে জড়িত না হয় তবে, সে প্রেম – ঘৃণা – বিচ্ছেদ কোনটাই ঠিকঠাক প্রসব করতে অক্ষম হন। তার তৃতীয় কবিতা ‘লুইজালে’-তে সে উচ্চারণ করছে – “বিলের ধারে বটগাছটি আমার মা/ বাবা হয়তো লুইজাল নিয়ে মাছ ধরতে গেছে” (লুইজালে; ১৩পৃ.) তখন বুঝতে পারা যায় একই প্যাটার্নের কবিতা শত শত লেখা হলেও নোমান ধাক্কাটা কোথায় দিতে চান। তিনি খুঁজছেন এক বিবর্ণ টোন এবং সেই টোন ধরেই তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ও না পৌঁছানোর গন্ডি টপকে যাচ্ছেন। ‘বাজিমাত’ শব্দটি তার কবিতার সাথে যায় না। যেটা যায় তা হল ঢ়রয়ঁব। যেটা সব কবি পারেন না। ব্যক্তিগত দুঃখ, বেদনা ও নৈব্যর্ক্তিকতা তার এই কাব্যগ্রন্থের বৈশিষ্ট্য। সে নির্বাসন দন্ডের আসামী। যে নিজেকে কাঠগড়ায় তুলে ধরেছেন এবং কখনও জীবনের টানাপোড়েনের রাজসাক্ষী হয়েছেন কবিতায়। কোনোরকম শঠতা ও কপটতা তার কবিতার মধ্যে নেই। কবিতা বানানোর প্রবঞ্চনায় বিশ্বাসী সে নয় একেবারে, কবিতার বইটির পাঠক হয়ে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি। আপাতদৃষ্টিতে তার কবিতা মনোটনাস হলেও, সামাজিক শেকলে ও বিত্তের শেকলে বাঁধা পড়া মানুষের ছটফটানির কথাই বলে। “লুইজালে” পাঠের পূর্বে কবির জীবন বা সাধনাস্থল ঘুরে আসা জরুরি মনে হয়েছে,কেননা তাঁর কয়েকটি শব্দের অর্থ এখনো জানা নেই। হয়তো কবিতা পুনঃপুনঃ আবিষ্কারের একটা ছল করেই। সেজন্য মাহমুদ নোমানের কবিতা নিয়ে পুরোপুরি লেখা সম্ভবপর নয়। কিন্তু নোমানের এসব শব্দকে আমার বাড়তি মনে হয় নি বরঞ্চ একটা চিত্রকল্প বুনন করে দিয়েছে। গীতিময়ে বাক্যের চলন আমাকে টেনে নিয়েছে, সেটি একটি গ্রাম – সবুজে সুশোভিত এবং নির্ভেজাল পরিবেশপরিস্থিতির সফল রূপায়ন। মাহমুদ নোমানের সেই ইছামতী নদী। সবশেষে এটুকু বলতে পারি বইটিকে আদর দিন মন জুড়াবে নিশ্চিত ।