মাস্টারদা সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদার

270

বাঙালি জাতির জীবনে ১২ জানুয়ারি ঐতিহাসিক গৌরবের দিন। আমরা জানি, ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি বিপ্ল­বী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ও বিপ্ল­বী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদারকে ব্রিটিশ শাসকরা নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে ফাঁসি দেয়ার আগে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে প্রায় অর্ধমৃত করে ফেলে। পরে রাত ১২ ঘটিকার সময় একই দিনে একই সময়ে ও একই মঞ্চে চট্টগ্রাম কারাগারে ফাঁসি দেয় ব্রিটিশ শাসক। তাদের মৃতদেহ দুটি আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাক্সিক্ষদের কাছে ফেরত না দিয়ে ভোর হওয়ার পূর্বে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে একটা জাহাজে করে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দেয়। উল্লে­খ্য যে, চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের স্থান ছিল সপ্তম। বিদ্রোহের একমাস পূর্বে ১৭টি বোমার জন্য ‘পিক্রিক’ পাউডার বিস্ফোরক তৈরির সময় ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর বাঁচবার কোন আশা ছিল না। বুক, হাত ও মুখ পুড়ে গিয়েছিল, শুধু তাই নয় শরীরের নানা অংশের হাড় পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ে। শরীরের অবস্থা ভয়াবহ হয়েছিল। ঐ অবস্থায় কাতর কণ্ঠে অনন্ত সিংহকে বলেছিলেন, ‘আপনি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলে সংগঠনকে বাঁচান।’ কিন্তু মাস্টারদা’র নির্দেশে তাকে গোপনে গ্রামে স্থানান্তরিত করে, চিকিৎসা করে বাঁচিয়েছিলেন সকলে। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ায় ১৮ এপ্রিল যুব বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, কিন্তু সামান্য সুস্থ হয়ে গ্রামে পার্টি-সংগঠনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২২ এপ্রিল জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ে মাস্টারদা তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গে গ্রামে এসে মিলিত হয়ে আত্মগোপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
১৯৩০-১৯৩১ সালে ডিনামইট ও ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে বন্দিমুক্তি ও ব্রিটিশ প্রশাসন অচল করার পরিকল্পনার উদ্যোগে মাস্টারদা, নির্মল সেন এবং তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ল্যান্ড মাইন প্রস্তুতের জন্য প্রচুর পরিমাণে গানকটন ও বিস্ফোরক তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন। ১৯৩১ সালের ৩১মার্চ আত্মগোপনকালে প্রকাশ্য দিবালোকে ‘বরমা’ গ্রামে একদল সশস্ত্র পুলিশের সঙ্গে তারকেশ্বর দস্তিদার ও আত্মগোপনকারী বিনোদ বিহারী দত্তের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে একজন কুখ্যাত পুলিশ ইনস্পেক্টরকে গুরুতভাবে আহত করে উভয়েই উধাও হয়ে যান। ১৯৩৩ সালের মাস্টারদা গ্রেফতারের পর চট্টগ্রামের বিপ্ল­বী নেতৃত্বভার তাঁর উপর পড়ে। মাস্টারদার পর ইন্ডিয়া রিপাবলিকান আর্মির (চট্টগ্রাম শাখার) দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তারকেশ্বর দস্তিদার। জেলে মাস্টারদার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে মুক্ত করে আনার প্রচেষ্টা করেছিলেন এবং বিপ্ল­বী দলের বোমা তৈরির বিশেষজ্ঞ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। আনোয়ারা উপজেলার গহিরা আত্মগোপন কেন্দ্রে তাঁর লিখিত ‘ড. রমন’ ছদ্মনামে বিভিন্ন ধরনের বোমা তৈরির ফর্মুলা সম্পর্কিত একটি খাতা পাওয়া গিয়েছিল যেটি বিচারের সময় ‘এক্সিবিট’ করা হয়েছিল। ১৮ মে ১৯৩৩ গহিরা যুদ্ধে গ্রেপ্তারের পর মেজর কিম তারকেশ্বর দস্তিদারকে বুটজুতা পরিহিত পা দিয়ে লাথি মারলে তাঁর চোখের ভিতর থেকে ফিন্কি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে।
গৌরবগাঁথা দুই মহান বিপ্ল­বীর ঐতিহাসিক ফাঁসির দিনটিকে স্মৃতিবহ করে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে বিপ্লবীদের ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিপ্ল­বী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ও বিপ্লবী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির মঞ্চটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে শ্রদ্ধার সহিত সাজিয়ে রেখেছেন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে, একই মঞ্চে ২ (দুই) জন প্রাণদান করলে উক্ত ফাঁসির মঞ্চে বিপ্ল­বী মহায়নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের ম্যুরাল ও পাথর লিপিতে নাম লিপিবদ্ধ থাকলেও তারকেশ্বর দস্তিদারের ম্যুরাল ও পাথরলিপিতে নাম না থাকায় উপমহাদেশের বিপ্ল­বী প্রেমিকগণ বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ক্ষোভের সাথে আবেদন করে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু প্রশাসনের নীরব ভূমিকা থাকায় আমরা হতাশ ও হতবাক। এইভাবে চলতে থাকলে একদিন ইতিহাস পথ হারাবে। সেহেতু আমরা গত ২৬/৮/২০১৮ইং তারিখে মাননীয় জেলাপ্রশাসক মহোদয়ের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেও কোন সাড়া না পেয়ে আবারও সমগ্র জাতির কাছে বিপ্লবী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদার যাতে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তার ম্যুরাল নির্মাণ ও পাথর লিপিতে নাম সংযুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন এই আশা ব্যক্ত করছি।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বিপ্ল­বী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ