মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিশংসনের প্রচেষ্টার একটি পর্যালোচনা

53

বলা হয়ে থাকে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালি ও গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো এমেরিকা। পরের দেশগুলোর মধ্যে শুনা যায় চিন, ভারত ও আরব দেশগুলোর মধ্যে অর্থাৎ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে হলো ইরান, সৌদি এরাবিয়া, মিশর এবং ওদিকে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া যদিও এই দুটি দেশ হলো অমুসলিম। ইসরাইলের বেশি কথা আজকে আলোচন্য বিষয় নয়। ইংল্যান্ড এতে আছে। আজকে এমেরিকার প্রেসিডেন্ট সম্বন্ধে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসনের জন্য শুনানির প্রক্রিয়া চলছে। কংগ্রেস কমিটির সামনে এখন সাক্ষীদের শুনানি ও জেরা চলছে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ। তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন যেন তিনি সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করেন। বাইডেন আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রতিদ্বনদ্বীর ভাবমুর্তি বিনষ্ট করার অপ্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। আর সেটা করেছেন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার অপব্যবহার করে। তিনি ইউক্রেনকে দেয়া সামরিক সহায়তা স্থগিত করার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগেই ট্রাম্পের অভিশংসন তদন্ত শুরু করেছে ডেমোক্রটেরা। সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন প্রার্থী জো বাইডেনকে কালিমালিপ্ত করতে ট্রাম্প বিদেশী সাহায্য চেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে দেয়া সামরিক সহায়তাকে তিনি দরকষাকষির হাতিয়ার করছেন। শুনানিতে ডেমোক্রাটদের প্রমাণ করতে হবে যে, প্রেসিডেন্ট সত্যিই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এটি একটি প্রকাশ্য প্রক্রিয়া এবং মার্কিন জনগণ টিভির পর্দায় প্রতিদিনের শুনানি দেখছে। এই প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পকে অভিশংসন করা যাবে কিনা সেটি একটি বড় প্রশ্ন। এমেরিকার প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ বা অভিশংসন করার বিধান তাদের সংবিধানে আছে। অতীতে একাধিক প্রেসিডেন্ট ইমপিচমেন্টের শিকার হয়েছে এবং একজন ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হয়ে পদত্যাগ করেছেন। ১৮৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যাÐ্রু জনসন এবং ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন অভিশংসিত হন। তবে তাদের পদ ছাড়তে হয়নি। সিনেটের বিচার প্রক্রিয়ায় দু’জনই খালাস পেয়ে যায়। আর প্রেসিডেন্ট নিক্সন ওয়াটার গেট কেলেংকারির কারণে ইমপিচড হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন ১৯৭৪ সালে। ট্রাম্পের অভিশংসন প্রক্রিয়া নিয়ে সারা বিশ্বেই চলছে আলোচনা। সবার নজর এখন ওই শুনানির দিকে। তবে প্রক্রিয়াটি বেশ ‘কঠিন’-এই অর্থে যে, অভিযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হলে প্রতিনিধি পরিষদে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অপরাধ বা অসদাচরণের অভিযোগ আনতে হবে। তারপর কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে যথাযথ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সে অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। কেবল তারপরই হতে পারে অভিশংসন। এ ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তারা শুনানি শুরু করতে পেরেছেন। বিষয়টি অভিযোগ আকারে তুললে তারা হয়তো সেটি পাসও করাতে পারবেন। কারণ এখানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট। প্রস্তাবের পক্ষে পড়তে হবে মোট ২১৩টি ভোট। ৪৩৫ আসনের মধ্যে তাদের আছে ২৩৩ জন সদস্য। কিন্তু ১০০ সদস্যের সিনেটের উচ্চকক্ষে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং তাকে রাষ্ট্র প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিতে হলে লাগবে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্টতা। অর্থাৎ এতে অন্তত ৬৭ জন সিনেটরের সমর্থন লাগবে। অথচ ডেমোক্র্যাটদের আছে মাত্র ৪৭ জন সদস্য। যদি রিপাবলিকান দলে ২০ জন সিনেটর প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে ভোট দেন, তবেই সম্ভব অভিশংসন। বেশির ভাগ বিশ্লেষক একমত যে, এমনটি ঘটার সম্ভাবনাও কম। তবুও ডেমোক্যাটরা কেন এ প্রক্রিয়াটি নিয়ে এগোচ্ছেন?
এর কারণ বিশ্লেষণ করেছেন অনেক পর্যবেক্ষক। বিবিসির বিশ্লেষক অ্যান্টনি জার্কার বলছেন, এ প্রশ্নের উত্তর আছে মার্কিন নির্বাচন-পূর্ব রাজনীতির হিসাব নিকাশে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের চেষ্টা হবে কিনা, এ নিয়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভেতরে আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে। যারা এই প্রক্রিয়া নিয়ে এগোতে চান তারা মনে করেছেন অভিশংসনের একটা আনুষ্ঠানিক তদন্ত প্রক্রিয়ার লক্ষ্য হবে। এমেরিকার জনমতে পরিবর্তন আনা। তাদের মতে, মার্কিন জনমত এখন এর পক্ষে না থাকলেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগৃহীত হলে এবং তা জোরালোভাবে উপস্থাপিত হলে জনগণ এর পক্ষে আসবে। অনেক ডেমোক্র্যাট মনে করেন। অভিশংসন একটা নৈতিক দায়িত্ব। তাদের মতে, প্রেসিডেন্ট নিজেই আইন ভেঙ্গে গেছেন। ফলে তার শপথবাক্য লংঘন করেছেন। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এর অর্থ হবে এতে পরোক্ষ সম্মতি দেয়া এবং আরো আইন ভাংতে তাকে উৎসাহিত করা।
শুনানির প্রথম দিনে সাক্ষী হিসেবে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কুটনীতিক ইউক্রেনের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের ‘অনৈতিক’ চাপের কড়া সমালোচনা করেছেন, ইউক্রেনে অস্থায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইরিয়াম টেলর বলেন, ট্রাম্প সত্যি ইউক্রেনে বাইডেনের কার্যকলাপের তদন্তে প্রবল আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। সে দেশের সরকারকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য চাপ দিতে তার প্রশাসন ৩৯ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের সামরিক সাহায্য আটকে রেখেছিল। টেলরের মতে, ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী হিসেবে রুডি জুলিয়ানি সরাসরি ইউক্রেনকে এমন কড়া বার্তা দিয়েছিলেন। এই ঘটনার ফলে রাশিয়ার আগ্রাসী আচরণের মুখে ইউক্রেন অসহায় হয়ে পড়েছে এবং মার্কিন কৌশলগত স্বার্থের ক্ষতি হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। শুনানিতে সাক্ষ্য দিয়েছেন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলেকজান্ডার ভিলম্যান শুনানিতে তিনি বলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সাথে টেলিফোনে কথাবার্তায় রাজনৈতিক সুবিধা চেয়েছিলেন ট্রাম্প। তার এমন বক্তব্যে কড়া সমালোচনা করেছেন হোয়াইট হাউজ। ডেমোক্র্যাটদের আশা ধীরে ধীরে হলেও ক্ষমতাসীন দলের ঐক্যে ফাটল ধরবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সাক্ষাতকারে এ শুনােিক ‘পুরোপুরি ছাইপাশ’ বলে অভিহিত করেছেন। একটি টিভি চ্যানেলকে ট্রাম্প বলেন, তিনি আশা করেন না। ‘ইমপিচড’ হবেন। ট্রাম্পের এই রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
অবশ্য ট্রাম্প আগাগোড়াই একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা যেমন ছিল বিতর্কিত, তেমনি তার কার্যকলাপও। উঠতে-বসতে তিনি কবে কখন কোথায় কতগুলো মিথ্যা কথা বলেছেন, তারও হিসাব প্রতিদিন প্রকাশ করেছে একটি বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক। তার অভিবাসনবিরোধী অবস্থান। নারী লোলুপ চরিত্র, জলবায়ু ইস্যুতে নেতিবাচক মনোভাব ইত্যাদি বিশ্ববাসীর জন্য যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা। তার সরকারের বিশ্বব্যাপী মুসলিম বিদ্বেষ। ইসলামো ফোবিয়ার বিস্তার এবং খ্রিস্টীয় জঙ্গিবাদ উসকে দেয়া। ফিলিস্তিনে হুইদি রাষ্ট্রের পক্ষে নগ্ন সমর্থন, ইরাকের সাথে ছয় জাতির অত্যন্ত ইতিবাচক পরমানু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিশ্বের মুসলমানদের মর্মবেদনার কারণ। মূলত গোটা বিশ্বব্যবস্থাকেই একটি ইতিবাচক ধারা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মুখে ঠেলে দিয়েছেন লোকটি। মার্কিনীরা এমন একটি মানুষকেই তাদের নেতা হিসেবে আগামী নির্বাচনেও বেছে নেবেন। এমন মনে হয় না। তবে খলচরিত্রের লোকদের নির্বাচনে জেতার নানা কৌশল আছে। ভোট কারচুপির নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার দৃষ্টান্ত বিশ্বে কম নেই। কিন্তু চলমান বিশ্বব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট