মারমা জাতিগোষ্ঠীর পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসন

477

প্রাচীনকাল থেকে আরাকান ও বাংলারএকটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগছিলো। ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে আরাকান থেকে দফায় দফায় আরাকানী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছে। এসব অভিবাসীর বৃহৎ অংশই ছিলো মারমা নৃগোষ্ঠী, যাদেরকে সাধারণভাবে মগ নামে অভিহিত করা হতো। বান্দরবানের, বোমাং রাজ বংশধর ও খাগড়াছড়ির মং রাজ বংশধর মারমাদের এদেশে আগমনের ইতিহাস বিবেচনা করতে গেলে; বেঙ্গল সিক্রেটস এন্ড পোলেটিক্যাল কনসালটেশান (৪ ফেব্রুয়ারি ১৭৯৫), ‘ফ্রান্সিস বুখাননের ভ্রমণ ডায়েরী’ (১৭৯৮), টি.এইচ.লুইনের ‘এ ফ্লাইঅন দি হুইল’ (১৮৭৯), স্যার আর্থার প্রেইরির ‘হিস্ট্রি অববার্মা’ (১৮৮৩), জর্জ গ্রীর্য়াসনের ‘লিঙ্গুইস্টিক্স সার্ভে অবইন্ডিয়া’ (১৮৯১), জি ই হার্ভের ‘হিস্ট্রি অববার্মা’ (১৯২৫), বি আরপার্ণ এর ‘কিং বেরিং’ (১৯৩৩), পিয়ের ব্যাসানেতের ‘ট্রাই বসম্যান অব চিটাগাং হিলট্রাক্টস (১৯৫৪) ইত্যাদি নথি, প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও গ্রন্থের আলোকে তা মূল্যায়ন করতে হবে। সা¤প্রতিক কালে আবদুস সাত্তার, আবদুল মাবুদ খান, আবদুল হক চৌধুরী, মুস্তফা মজিদ, আতিকুর রহমান, জামাল উদ্দিন প্রমুখ লেখক এ বিষয়ে কিছুটা পূর্বতন তথ্য যাচাই এবং কিছুটা নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে একটা মোটামুটি ধারণায় পৌঁছুতে পেরেছেন যে প্রাচীন আরাকান থেকে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে মারমাদের একটি বৃহৎ দল ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছে।
মিলস (১৯২৭) ও হাসিন সনের (১৯০৬) মতে ‘মারমাদের চট্টগ্রামে আগমনের ইতিহাস সপ্তদশ শতাব্দীর’। মিলসের মতে ‘কক্সবাজার থাকাকালীন সময়ে মারমারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে অভিবাসনের পথ বেছে নেয়। কিছু মারমা এগিয়ে আসে মূল বাংলার দিকে। অন্য দুটি বেছে নেয় হিল ট্রাক্টের পথ’ (তালাশ: ভল্ফগাং মে: ১৯৯৬: ২৪)। সুগত চাকমার মতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমাদের অভিবাসন ঘটে দু’টি দলে। ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজ বোদাপায়া কর্তৃক আরাকান অধিকৃত হলে আরাকানবাসীরা সেখান থেকে দলে দলে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে অভিবাসিত হয়। আরাকান থেকে শরণার্থী হয়ে আসা প্রথম দলটি বান্দরবান জেলার মাতা মুহুরী নদীর উপত্যকায় চলে আসে। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড পাহাড় হয়ে চট্টগ্রামের উত্তরাংশ মানিকছড়ির আশে পাশে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় দলটি বান্দরবান জেলার শংখ নদীর তীরে বর্তমান বান্দরবান শহরে অভিবাসিত হয়’ (সুগত চাকমা: ১৯৮৮: ৫)। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত হলে কোংলাপ্রু বোমাং বংশধরদের দলপতি হিসাবে বান্দরবান এলাকার কর সংগ্রাহক নিযুক্ত হন। ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সার্কেল গঠিত হলে কোংলাপ্রুর পরিবারের বোমাং খেতাবের স্মারকরূপে বোমাং সার্কেলের নামকরণ করা হয়।
‘১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের প্যালাইংক্ষ্যং নদীর উপত্যকায় বসবাসকারী প্যালাইংসা মগবামং বংশের গোত্র প্রধান ম্রাচাই দাহবইং (ধাবিং) তার কয়েক হাজার অনুগামীসহ আরাকান ত্যাগ করে চট্টগ্রামে শরণার্থী হয়ে আসে এবং তারা ইংরেজ সরকারকে কার্পাস তুলা কর হিসাবে দেওয়ার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মাতামুহুরী নদীর উপত্যকায় বসতি স্থাপন করে। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ম্রাচাই ধাবিং নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার ভাইপো খেদু গোত্র প্রধান হন। তিনি তার অনুগামী প্যালেইংসা মগবামং বংশধরদের নিয়ে মাতামুহুরী উপত্যকা ত্যাগ করে সীতাকুন্ড পাহাড়ে চলে আসেন এবং সেখানে একটি কার্পাস মহল লাভ করেন। ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দে খেদুর মৃত্যুর পর তার পুত্র ক্য অংজাই সীতাকুন্ড পাহাড়ের প্যালেইংসা মং বংশধরদের গোত্র প্রধান হন। তিনি উত্তর চট্টগ্রামে কুঞ্জ ধামাই নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি রাঙ্গুনিয়া থানার পাহাড়তলী গ্রামে মহামুনি বৌদ্ধ মন্দির ও দিঘি খনন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে সীতাকুন্ড পাহাড়ে মারমা পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮৭ এ। ক্রমে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা সীতাকুন্ড পাহাড় পরিত্যাগ করে চট্টগ্রামের উত্তরপূর্ব সীমান্তবর্তী পার্বত্য এলাকা মানিকছড়িতে অভিবাসিত হয়’ (জামাল উদ্দিন: ২০১১: ১৫৭-১৫৮)। কালক্রমে তারা রামগড়, হেঁয়াকো, মহালছড়ি, মাটিরাঙ্গা, পানছড়ি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। স্মর্তব্য যে, বর্তমানে মারমা নৃগোষ্ঠী নামে অভিহিত এই অরণ্যচারী জনগোষ্ঠী কখনো ক্ষ্যংথা, কখনো রিগেসা, কখনো ককদাইসা এরূপ ভিন্ন ভিন্ন নামে স্মরণাতীত কাল থেকে আরাকানের রোমা পর্বতশৃঙ্গ থেকে হিমালয় পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত কাইখ্যং, রিগেখং উপত্যকায় যাযাবর জীবন বিচরণ করতো। কালক্রমে এই অভিবাসী আরাকানী বংশোদ্ভুত বোমাং ও মং জনগোষ্ঠীর স্রোতধারা মিলিত হয়ে এবং আধুনিক মারমা জাতিসত্ত্বার সাথে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম অবধি বসতি স্থাপন করেছে।
মারমা ইতিহাস বেত্তা বি. আরফার্ন এর মতে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরাকানের দুই তৃতীয়াংশ অধিবাসী স্বদেশ ত্যাগ করে। সেবছরই কমপক্ষে দশ হাজারের একটি আরাকানী দল চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। ‘যেসব আরাকানী পূর্ব সময় থেকেই চট্টগ্রামে বসবাস করছিলো তারা অভিবাসী শরণার্থীদের সহযোগিতা করতে প্রয়াসী হয়। কিন্তু সীমাহীন খাদ্যাভাবে শরণার্থীরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। সে সময় গিরগিটি ও বনের লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর ছিলো না’ (বি. আর.ফার্ন: ১৯৩৩, রূপান্তর, মোশতাক আহমদ, ১৯৯৬: ৩৭ )। সে সময় একজন ইউরোপীয় পর্যটক পর্যটক ফ্রান্সিস বুখানন তার ভ্রমণ ডায়েরীতে উল্লেখ করেন, ‘তখন (জুন-১৭৯৮) কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে এত বিপুলসংখ্যক আরাকানী মৃত্যুবরণ করেছিল যে তাদের লাশ দিয়ে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রাস্তাটি ঢেকে দেয়া যেত’ (ভেনামভান সেন্দেল: ১৯৯৪: ৬৮)। এসময় কোম্পানী সরকার শরণার্থীদের খাদ্য ও গৃহনির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করে এবং আভারাজ্যে নিয়োজিত সাবেক কুটনীতিক ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে এসব ভাগ্য বিড়ম্বিত আদিবাসীদের পুনর্বাসনের কাজে তদারক করার জন্য প্রেরণ করে। ১৭৯৯ সালে হিরাম কক্স চট্টগ্রাম পৌঁছে রিপোর্ট করেন ‘বিগত ১২ মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার আরাকানী চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছে। পূর্ব থেকে বসবাসরত আরাকানী মিলিয়ে এদের বর্তমান সংখ্যাচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজারের কাছা কাছি’ (বি. আরফার্ন: ১৯৩৩: পূর্বোক্ত)। হিরাম কক্স দশ হাজারের মত আরাকানীকে কক্সবাজারের কাছে পিঠে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এর আগে ২০ থেকে ৩০ হাজার আরাকানী বনে জংগলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। কালক্রমে তারা বান্দরবানসহ কাছাকাছি অন্যান্য এলাকায় জনবসতি গড়ে তোলে। ‘মারমাদের এই অভিবাসনের বিষয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোনরূপ আপত্তি উত্থাপন করেনি কিছুটা মানবিক বিবেচনায় এবং কিছুটা এ কারণে যে, জন বিরল এ জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি কোম্পানীর অভিপ্রেত ছিল’ (বি. আর.ফার্ন: ৩৩)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মারম াঅভিবাসনের বিষয়ে কোনরূপ ভিন্নমত না থাকায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এখানে বসবাসরত মারমারা বান্দরবানের আদি বাসিন্দা নয়। কয়েকশ বছরপূর্ব থেকে তারা চট্টগ্রাম ও এর পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়গুলোতে স্বল্প সংখ্যায় বসবাস করে আসছিলো। ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজা কর্তৃক প্রাচীন আরাকান আক্রান্ত হলে সেখানকার মারমাগণ আরাকান ছেড়ে টেকনাফ, কক্সবাজার, রামু, উখিয়া ও মহেশখালী এলাকায় প্রবেশ করে। ঔপনিবেশিক শাসকরা অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে তাদের সাদরে গ্রহণ করায় তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আগ্রহী হয়ে পড়ে। কালক্রমে তারা তাদের সর্দার কোংলাপ্রুর নেতৃত্বে শঙ্খনদীর তীরবর্তী বান্দরবানে বসতি শুরু করে। ধীরে ধীরে অন্যান্য স্থান থেকে মারমারা এখানে এসে জড়ো হতে থাকে। এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে মারমাদের অভিবাসন সম্পন্ন হয়।