মানুষ কেন ভয় পায়, কিভাবে তাড়াবেন?

463

মাকড়সা? সার্কাসের ক্লাউন? উঁচু ভবন? পড়ে থাকা রক্তাক্ত শরীর? হঠাৎ দেখে চমকে চিৎকার করে উঠতে পারেন অনেকে। ভয় একটি শারীরিক প্রক্রিয়া নাকি পুরোটাই মনস্তাত্তি¡ক, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মানুষ আসলে ভয় পায় কেন? এবং ভয় তাড়ানোর কার্যকর পন্থা কি হতে পারে তা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের মনোবিজ্ঞানী এবং ভীতি সংক্রান্ত এক বইয়ের লেখক ড. ওয়ারেন ম্যানসেল বলেছেন, ‘এটা অভিব্যক্তিমূলক, এটা জীববিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত এবং এর মূল ব্যাপার হচ্ছে টিকে থাকা। যেকোনো ধরণের ভীতি বা ঝুঁকির মুখে পালানো বা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের শরীরের একটা প্রস্তুতি থাকা দরকার’।
সমাজবিজ্ঞানী ড. মারগী কের বলেছেন, ‘ভয়ের কারণ দ্রুত শনাক্ত করা এবং পরিত্রাণের উপায় বের করা জরুরি। এটাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে’।
বেশিরভাগ সময় মানুষ ভয় পেলে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ অর্থাৎ ভীতিকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে সেটা সামলনোর চেষ্টা করে অথবা সে পরিস্থিতির মুখে পালিয়ে যায় বা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। এ সময় মানুষের হৃদপিÐের গতি বেড়ে যায়, যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তবে, অনেকেই ঐ পরিস্থিতি সাহসের সাথে মোকাবেলা করে। কেউ আবার ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যান, লাফিয়ে ওঠেন।
এর কারণ মূলত যে ধরণের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে প্রস্তুতি নেবার মতো যথেষ্ট সময় পায়নি আপনার মস্তিষ্ক, কিন্তু আচমকা এবং বিকটভাবেই সে পরিস্থিতির সামনে পড়েছেন আপনি।
কত ধরণের ভীতি আছে
লন্ডনের হরর মঞ্চনাটক ‘ঘোস্ট স্টোরিজ’র সহ-নির্মাতা অ্যান্ডি নাইম্যান বলেন, প্রথমত: একদম লাফিয়ে ওঠার মতো ভীতি। লাফিয়ে ওঠার মতো প্রতিক্রিয়াকে মানুষ হাস্যকর ভাবে, কিন্তু বস্তুত এটা খুবই কঠিন এবং স্পর্শকাতর এক পরিস্থিতি। আপনি যদি ঠিক মতো বিষয়টি বোঝেন, তাহলে দর্শককে চমকে দিয়ে ভয় দেখানোর বিষয়টি অসাধারণ, কারণ তাদের কোনো প্রস্তুতিই থাকবে না ওই পরিস্থিতির মুখে পড়ার। আরেক ধরণের ভয় হচ্ছে, আপনি তাতে ঠিক চমকে উঠবেন না, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই যেন মেরুদন্ড বেয়ে শিরশিরে একটা অনুভূতি নেমে আসা টের পাবেন।
হরর সিনেমা নিয়ে যুক্তরাজ্যে একটি পডকাস্ট উপস্থাপনা করেন মাইক মান্সার, তিনি বলেন, ভয়ের সিনেমার মধ্যেও সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে যেটা মানুষের মাথার মধ্যে ঢুকে যায়, সিনেমা শেষ হবার বহুক্ষণ পরেও থাকে সেই অনুভূতি। এবং সবচেয়ে ভয়াল হচ্ছে, কোনো কিছু ঘটছে না নির্দিষ্ট দৃশ্যে, কিন্তু আপনি তবু ভয় পাবেন। যেমন ধরুন জনমানবহীন কোনো হোটেল করিডোর বা ছোট্ট একটা ছেলে একা একা ট্রাই-সাইকেলে চড়ার চেষ্টা করছে…. এসব দৃশ্য দেখে মানুষ নিশ্চিতভাবেই ভয় পায়।
নাটক বা সিনেমায় ভয়ের মূহুর্ত তৈরি
অ্যান্ডি মনে করেন আসলে সিনেমার ঐ বিশেষ দৃশ্য বা দৃশ্যমালা তৈরির জন্য আলোকসজ্জা বা লাইটিং থেকে শুরু করে মিউজিক এবং স্পেশাল এফেক্ট সব কিছুর ভূমিকা আছে। এবং সব কিছু ঠিকঠাক দেখাতে পারলে, আপনি ভাবুন, হলরুমে একসঙ্গে ৯০০ মানুষ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠছে! একজন নির্মাতার জন্য সেটা দারুণ এক অনুভূতি।
তবে একই ধরণের গল্পে প্রায় একই রকম দৃশ্য তৈরি করে দর্শককে ভয় পাওয়ানো সহজ কাজ না। কোনো কসাইখানার দৃশ্যও ভীতিকর হতে পারে যদি নির্মাতা মাছির ভনভন, পঁচা মাংসের গন্ধ আর স্যাঁতস্যাঁতে মেঝের অনুভূতি দর্শকের ইন্দ্রিয়ে ঢুকিয়ে দিতে পারেন।
ভয়কে জয় কিভাবে করবেন
মনোবিজ্ঞানী ড. ম্যানসেল বলেন, আপনি যদি খুব সহজেই চমকে যান, কিংবা বিশেষ কোনো ভীতি বা ফোবিয়া থাকে আপনার, তাহলে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে আপনি নিজে কিছু জিনিস চর্চা করতে পারেন, আবার প্রয়োজনে একজন থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে পারেন। এর প্রথম ধাপ হচ্ছে, নিজের মনকে প্রস্তুত করা, মানে আপনি জানেন বিশেষ কোনো পরিস্থিতি আপনাকে বিব্রত করে, সুতরাং এখনই তার মুখোমুখি না হয়ে, আপনার মন পুরোপুরি তৈরি হবার পরই আপনি তার মোকাবেলা করুন। যেমন অনেকের উচ্চতা ভীতি রয়েছে, তাদের উচিত একটু একটু করে মনকে প্রস্তুত করা।
আর ড. কের মনে করেন, এজন্য প্রয়োজনে এক্সপোজার থেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি এবং ব্রিন্দ্রিং এক্সারসাইজ করা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যায়ামও উপকার করে বলে তিনি মনে করেন।
কিন্তু সবকিছুর পরেও আচমকা মাকড়সা দেখলে, বা উঁচু কোনো ভবনের ছাদে কোনো ক্লাউন দেখে চমকে উঠবেন না এমন মানুষ কমই আছে। কিন্তু তেমন ঘটনা সচরাচর ঘটেই বা ক’দিন? সুতরাং এতো ভয় পেয়ে সারাক্ষণ সিটকে থাকার হয়তো কিছু নেই-এই বলুন মনকে এই বেলা।