‘মানসম্মত শিক্ষা’ অর্জনের প্রয়াসে বাংলাদেশ

358

জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এমডিজি(গউএ) বা সহ¯্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জনের সাফল্য দেখিয়ে প্রশংসিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার টেকশই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্র বা এসডিজি’র(ঝউএ) লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের জন্য এসডিজি এজেন্ডা সমূহের মধ্যে চ্যালেজ্ঞিং ক’টি লক্ষ্য হল দারিদ্র বিমোচন(এসডিজি-১), সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ(এসডিজি-৩),মানসম্মত শিক্ষা(এসডিজি-৪), সুপেয় পানি এবং পয়:নিষ্কাশন প্রণালী(এসডিজি-৬), কর্মসস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি(এসডিজি-৮), জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা(এসডিজি-১৩), এবং শান্তি, ন্যায় বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান সমূহ(এসডিজি-১৬)। বলাবাহুল্য এসডিজি-৪ বা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলেই অন্যান্য এজেন্ডা বা লক্ষ্য সমূহ অর্জন অনেকটা বেগবান ও সফল হবে। কারণ সকল সেক্টেরের জন্য চৌকশ ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরী করবে মানসম্মত শিক্ষা। তাই আমরা মনে করি মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যটি সর্বাগ্রে সবার কাছে গুরুত্ব পাওয়া উচিত। মানসম্মত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের জন্য গবেষক, একাডেমিশিয়ান, মাঠ পর্যায়ের শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা শিক্ষার সাথে যুক্ত সকলকে নিয়ে বৈশি^ক মান এর সাথে তাল মিলিয়ে তাত্তি¡ক কাঠামো তৈরী করতে হবে। অত:পর লক্ষ্য নির্ধারণ পূর্বক বাস্তবায়নের পদক্ষেপ কার্যকর করতে হবে।


আজকের এ ক্ষুদ্র লেখায় আমি প্রথমে ঊও (ঊফঁপধঃরড়হ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ) এর গবেষণার আলোকে মানসম্মত শিক্ষার ধারণা তুলে ধরার প্রয়াশ নিচ্ছি। শিক্ষা হচ্ছে মৌলিক মানবাধিকার। তাই মানসম্মত শিক্ষা সার্বজননীন ভাবে সকলের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া (ঝউএ) এসডিজির লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা ব্যতিরেকে অন্য কোন বিকল্প নেই। ঊও বলছে, সুবিধাভোগী কিছু মানুষকে আর্ন্তজাতিক মানের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করাই মানসম্মত শিক্ষা নয়। ধনী-দরিদ্র, লিঙ্গ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রান্থিক জনগোষ্ঠিসহ, গ্রাম-শহর এর সকল জনগোষ্ঠিকে সমমানের শিক্ষা নিশ্চিত করাই হল মানসম্মত শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। এ শিক্ষা জনগণকে জ্ঞানী, দক্ষ, নৈতিক ও সৃজনশীল করে গড়ে তুলবে যাতে তারা আঞ্চলিক ও বৈশি^ক সমস্যা সমাধান করে সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীল উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
ই.আই(ঊও) এর মতে মানসম্মত শিক্ষার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে টিউশন ফি এবং অন্যান্য পরোক্ষ খরচপাতি (ঞঁরঃরড়হ ভববং ধহফ ঃযব রহফরৎবপঃ পড়ংঃং ড়ভ বফঁপধঃরড়হ)। তাই সবার জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরী। যেহেতু শিক্ষা জনগণের কল্যাণ সাধন করে এবং মৌলিক অধিকার, তাই সরকারের আভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় থেকে সকল নাগরিকর শিক্ষার ব্যয় বহন করা উচিত। এসডিজি (ঝউএ) বাস্তবায়নের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে অর্থের জন্য যেন কোন নাগরিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।
ই.আই(ঊও) এর গবেষণাপত্র বলছে, সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে রাষ্ট্রে শান্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং টেকশই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষার সকল উপাদান যেমন-ক্যারিকুলাম পর্যাপ্ত পঠন-পাঠন, পঠন উপকরণ, শ্রেণি কক্ষ, দক্ষ ও পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
ব্রাসেলস ভিত্তিক এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল এর উপরোক্ত মানসম্মত শিক্ষা তত্তে¡র আলোকে আমরা যদি আমাদের বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রমকে তুলনা করি তাহলে বিদ্যমান অসামজ্ঞস্যতাগুলো নির্ধারণ করা সহজ হবে। পাশাপাশি (ঝউএ-৪) এসডিজি-৪ বাস্তবায়ন এর লক্ষে বর্তমান সরকার যে সচেষ্ট থেকে বিদ্যমান অসামজ্ঞস্যতা দূর করতে প্রয়াশী রয়েছেন তাও স্পষ্ট হবে। যেমন আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, নন এমপিওভুক্ত, বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, মাদ্রাসা শিক্ষা সহ বহুরকম শিক্ষা কার্যক্রম বিদ্যমান আছে। ক্লাসরুম সংকট তথা অবকাঠামো খাতে সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করে যাচ্ছে। বিনামূল্যে বই বিতরণ, মিড ডে মিল ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করেছে। কিন্তু তৎসত্তে¡ও বহু অসামজ্ঞস্যতা দিন দিন নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছে। আইন করেও কোচিং বাণিজ্য, গাইড বই বাণিজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে দক্ষ বিজ্ঞান শিক্ষকের সংকঠ এবং বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার ব্যয় বৃদ্ধি জনিত কারণে বর্তমানে বিজ্ঞান বিভাগের প্রতি অনীহার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আবার শহরাঞ্চলে সমস্যাগুলো অন্যরকম। এক্ষেত্রে সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একটু আত্ম সমালোচনা করতে চাই। সরকারী স্কুল ও কলেজ গুলোতে ক্লাস রুমে শিক্ষকরা পাঠদানে আগ্রহ কম দেখান, অনেক ক্ষেত্রে কিছু অজুহাতও সৃষ্টি করেন। পক্ষান্তরে নিজ নিজ বাসা, অলিগলিতে ভাড়া নেওয়া কক্ষে প্রাইভেট বা কোচিং এর নামে অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে পাঠদান ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। শহরাঞ্চলে বেসরকারী স্কুল এবং কলেজ গুলোর শিক্ষকদের মধ্যেও এ প্রবণতা বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করছে। অথচ এটি ই.আই(ঊও) এর মানসম্মত শিক্ষা কনসেপট এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
২০১৬ খ্রি. এর ৭ জুন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠেয় মানসম্মত শিক্ষার উপর এক গোলটেবিল আলোচনায় গবেষকরা অন্যান্য বিষয়ের সাথে প্রশিক্ষিত ও আন্তরিক শিক্ষকের উপর গুরাত্বরোপ করেছেন। আমাদের দেশে সরকার স্বল্প পরিসরে কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেও সে প্রশিক্ষণ কতটুকু শ্রেণি কক্ষে কাজে লাগানো হচ্ছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। বিভিন্নস্তরের শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র বেতন বৈষম্য বৈশি^ক কনসেপ্টের সম্পূর্ণ বিপরীত। দক্ষ ও আন্তরিক শিক্ষক তৈরীর জন্য বৈষম্যমুক্ত বেতন কাঠামো সকল শিক্ষকের জন্য নিশ্চিত করা আবশ্যক। পদন্নোতির ক্ষেত্রে অনুরুপ বৈষম্য লক্ষণীয়। বেসরকারী কলেজ গুলোতে পদন্নোতির কোন মানসম্মত বিধান নেই। মাথাগুনা পদ্ধতিতে কেউ কেউ বড়জোর ভাগ্যক্রমে সহকারী অধ্যাপক পদ পান। মেধাবী একজন শিক্ষক যদি পিএইচডি করে কোন কারণে বেসরকারী কলেজে শিক্ষকতাই যুক্ত হন তাহলে প্রভাষক হিসেবে তাঁকে সারা জীবন কাঠাতে হবে। অন্যদিকে কম মেধাবী কিংবা সাধারণ মানের একজন শিক্ষক যদি কোনভাবে সরকারি কলেজে (বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে) যুক্ত হন তাহলে তিনি প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক পদে উচ্চতর ধাপের বেতনক্রম ভোগ করে অবসরে যাবেন। বিষয়টি মর্মান্তিক এবং বৈশি^ক শিক্ষক মর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এ বিষয়গুলো যত দ্রæত সমাধান করা যাবে ততই মানসম্মত শিক্ষার অন্যতম শর্ত আন্তরিক ও দক্ষ শিক্ষক পাওয়া সহজ হবে। আশার কথা হচ্ছে জননেত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার শিক্ষা জাতীয়করণ এর কথা ভাবছেন। ইতোমধ্যেই ৩৩০টি কলেজ জাতীয়করণ করেছেন। যা ২০৩০ সালের মধ্যে এস ডি জি (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষ) লক্ষ্যসমূহ পূরণ করার জন্য মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে অন্যান্য লক্ষ্যসমূহ অর্জনের ভূমিকা পালন করবে। মানসম্মত শিক্ষার যে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্থাৎ নাগরিকরা আঞ্চলিক ও বৈশি^ক সমস্যা সমাধান করার উপযোগী হয়ে উঠবে যা তাদেরকে এসডিজি’র অন্যান্য লক্ষ্যপূরণে সফল করে তুলবে।
লেখক : অধ্যক্ষ ও প্রাবন্ধিক