মানব পাচারকারীদের তৎপরতা কঠোরভাবে দমন করতে হবে

52

বাংলাদেশে এখন মারাত্মক সমস্যার নাম রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের এসব অধিবাসী দেশটির রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হওয়া থেকে রক্ষা পেতে এদেশে পালিয়ে এসেছে। সরকার মানবিক বিবেচনায় তাদের সীমান্তবর্তী কক্সবাজারে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে এগারো লাখ। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে বিশাল একটি অভিবাসী দল কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। বিশ্বব্যাপী আলোচিত নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সরকার প্রধান প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার চেয়ে তাদের ক্যাম্পগুলো সুরক্ষা করা এখন অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ছে বলে আমাদের ধারণা। দৈনিক পূর্বদেশসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্র জানিয়েছে, মানব পাচারকারীদের বিশাল একটি সিন্ডিকেট রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের নানা কৌশলে বিভ্রত করে ক্যাম্প থেকে ভাগিয়ে নিয়ে অবৈধ পথে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করছে। আর এ সুযোগটা গ্রহণ করা হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যথাযথ সুরক্ষার অভাব থেকে। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয়গ্রহণকারীদের দৈনন্দিন তদারকিও যথাযথ নয় বলে জানা গেছে। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে উল্লেখ করা হয়, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কতজন আশ্রয়শিবিরে আছে আর কতজন শিবির থেকে পালিয়ে গেছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব সরকারের কোনো সংস্থার কাছে নেই। যদিও আগত রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র তৈরি করেছিল সরকার। আশ্রয়শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৫৮ হাজার ৫৮৪ জন আটক হয়েছে। কিন্তু যারা ধরা পড়েনি, তাদের সংখ্যা কখনো জানা যাবে না।
গতকাল বুধবার দৈনিক পূর্বদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে গত কয়েকদিনে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে আটক করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। কাগজে-কলমে পাঁচ শতাধিক ধরা পড়লেও নানা কৌশলে বাংলাদেশ ছেড়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা- এমন অভিমত সংশ্লিষ্টদের। এছাড়াও বাংলাদেশের নানান জেলায় ছড়িয়ে গেছে লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী- এমন ধারণা সংশ্লিষ্টদের। প্রতিদিনই নানান কৌশলে ক্যাম্প থেকে পালাচ্ছে তারা। যথাযথ মনিটরিং, প্রশাসনিক উদাসীনতার পাশাপাশি লোকবল স্বল্পতা, বিভিন্ন এনজিও-আইএনজিও’র বাড়াবাড়ি ও সহযোগিতায় সহজেই ক্যাম্প ত্যাগ করছে এসব শরণার্থী। বাংলাদেশ এবং বিদেশে স্থায়ী হতে তাদের এই তৎপরতা আশংকাজনকভাবে বেড়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ১১ লাখ ২৮ হাজার ৫২৯ জন। তাদের রাখা হয়েছে ৩৪টি শিবিরে। এদের নিরাপত্তা রক্ষায় আছে সাতটি টহলচৌকি কিংবা ৯৫০ জন পুলিশ সদস্য। এই সীমিত লোকবল দিয়ে এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ওপর নজরদারি করা সম্ভব নয়। তদুপরি এসব শিবিরে কোনো সীমানাপ্রাচীর বা কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় কে কখন বের হলো বা প্রবেশ করল, সেটি যাচাই করা সম্ভব হয় না।
শুধু বিদেশে পাচার নয়, শিবির থেকে বেরিয়ে আসা রোহিঙ্গারা দেশের ভেতরেও নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে পরিচয় লুকিয়ে কাজ করছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকদের বিয়েও করছে রোহিঙ্গারা; মিশে যাচ্ছে স্থানীয়দের সাথে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ভাষা, খাদ্য ও পোশাকে মিল থাকায় রোহিঙ্গারা একবার শিবিরের বাইরে যেতে পারলে তাদের ধরা কঠিন। শিবিরের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় শিবিরের বাসিন্দারা বাইরে আসছে। আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি থাকলেও শিবিরের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। এছাড়াও ইয়াবাসহ নানান মাদকের পাচারকালেও রোহিঙ্গা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। তাদের এমন বেপরোয়া আচরণে প্রশাসনের কপালেও ভাঁজ পড়েছে। এই ধারা চলতে থাকলেও ভবিষ্যতে তারা দেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলেও অনেকের আশঙ্কা। এদের কারণে সামাজিক অপরাধও বেড়েছে। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ত্যাগের ঘটনা আমাদের জন্য সুখকর নয়। পাচারকারী এবং স্বেচ্ছায় ক্যাম্পত্যাগকারীদের ঠেকাতে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া প্রয়োজন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হলে সেখান থেকে সহজে বের হওয়া সম্ভব হবে না।