মানবেতর জীবনযাপন নৌযান শ্রমিকদের

18

বৈশ্বিক করোনায় পুরো পৃথিবী স্তব্ধ। স্তব্ধ সব কর্মযজ্ঞ। এ অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষেরা। যে মানুষেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে সংসারের চাকা ঘোরাতেন তারাই আজ সবার করুণার পাত্র হয়ে গেছেন। ঘরবন্দি থেকে তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। নিজের শেষ সম্বল যা ছিল তা ফুরিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।
করোনার কারণে রাঙামাটি নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের ৩শ সদস্য প্রায় বেকার হয়ে পড়েছেন। বাড়িতে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় চুলায় আগুন জ্বালাতেও কষ্ট হচ্ছে। হতাশায় অবসাদ জীবন পার করছেন তারা। অপেক্ষা করছেন কখন তাদের রোজগারের চাকা ঘুরতে শুরু করবে। স্থানীয়ভাবে সরকারি কিছু ত্রাণ পেলেও তা ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই। গত মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় তারা এখন মানবেতর জীবন পার করছেন। খবর বাংলানিউজের
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের শ্রমিক ইউনিয়নের জন্য রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে একবার এক টন চালের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এরপর স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে আর সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ শ্রমিক জেলার বাইরে থেকে এসে কাজ করেন। এখানকার ভোটার না হওয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিধিরা তাদের কোনো খোঁজ-খবর নিচ্ছেন না। কারণ সামনে পৌর নির্বাচন। তাই কাউন্সিলরা সরকারি এসব ত্রাণ তাদের ভোট ব্যাংক এলাকায় দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
শ্রমিক এবং লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাঙামাটি জেলা শহরের সঙ্গে ৬টি উপজেলার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো নৌ-পথ। এর মধ্যে নানিয়ারচর, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু এবং বাঘাইছড়ি উল্লেখযোগ্য। এই রুটগুলোতে প্রায় ৫৩টি লঞ্চ চলাচল করে। প্রতিটি লঞ্চে চালক, সারেং এবং মিস্ত্রীসহ ৫-৬ জন শ্রমিক নিয়োজিত থাকে।
এদের মধ্যে মালিক পক্ষ থেকে চালকের বেতন মাসিক ২৫ হাজার টাকা, সারেং এর ২০ হাজার, মিস্ত্রির ১৮ হাজার এবং শ্রমিকদের জনপ্রতি মাসিক বেতন ১২ হাজার টাকা দেওয়া হয়ে থাকে।
বর্তমানে দেড় মাস লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় মালিক পক্ষ তাদের বেতন দিতে পারেনি।দেড় মাস ধরে বেতন না পাওয়ায় তারাও কষ্টে পড়েছেন। বেতন না পাওয়ায় বাইরের শ্রমিকরা নিজেদের বাড়ি-ঘরেও যেতে পারছেন না। কারণ সামনে ঈদুল ফিতর। টাকা ছাড়া বাড়ি যাবেন কীভাবে। আর স্থানীয় শ্রমিকরা বাড়িতে বেকার থেকে কোনোরকমে দিন অতিবাহিত করছেন।
রাঙামাটি নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য লঞ্চ চালক গিয়াস উদ্দীন বলেন, ভাল নেই আমরা, বর্তমানে কোনো ইনকাম নেই আমাদের। বেকার সময় পার করছি, পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে জীবন পার করছি। ঘর ভাড়া আটকে গেছে। রোজগার না থাকায় ঠিকমতো খাবারও কিনতে পারছিনা। কবে এ অবস্থা থেকে নিস্তার পাবো আল্লাহ ভাল জানেন।
রাঙামাটি নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ দে বলেন, আমাদের সমিতি থাকলেও ফান্ডে উল্লেখযোগ্য কোনো টাকা নেই। যে কারণে শ্রমিকদের আপদকালীন সহযোগিতা করতে পারছি না। কারণ আমাদের সমিতির তেমন কোনো আয়-রোজগার নেই।
রাঙামাটি নৌযান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল হক বলেন, আমাদের অল্প কিছুদিন সহায়তা করেছিলেন নৌ-চলাচল সংস্থা রাঙামাটি শাখার চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন সেলিম। এরপর আর কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাইনি। আমার শ্রমিকরা অনেক কষ্টে দিন পার করছে। একবেলা চুলায় আগুন জ্বললেও আরেক বেলায় উপোস থাকতে হচ্ছে। সরকারি প্রণোদনা না পেলে আমাদের টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। তাই এ ব্যাপারে আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা রাঙামাটি অঞ্চলের চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন সেলিম বলেন, লঞ্চগুলো দেড় মাস ধরে বন্ধ থাকায় আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। অনেকের ব্যাংকের ঋণ রয়েছে তাদের ঘাড়ে ঋণের চাপ বেড়ে চলেছে।
তিনি বলেন, মালিক সমিতির পক্ষ থেকে শ্রমিকদের কয়েকবার ত্রাণ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলাম। কিন্তু ত্রাণ দিয়ে তো তাদের জীবন চলে না। তাদের ঘর ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ কে চালাবে। যা ত্রাণ দিয়েছিলাম তাও যৎসামান্য।
তিনি আরও জানান, আমার লঞ্চের শ্রমিকদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি তাদের মুখে অন্তত দুবেলা অন্ন তুলে দিতে। এখন আমার মতো লঞ্চের অন্যান্য মালিকরা সেই কাজ করছেন কিনা বা তাদের সেই সামর্থ্য আছে কিনা সেটা দেখার বিষয়।