মানবতা ও আজকের সমাজ ব্যবস্থা

865

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আদিকাল থেকে সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে মানুষ তার প্রয়োজনে সামাজিকভাবে জীবনযাপনের লক্ষ্যে কিছু নিয়মনীতি শৃংখলাবোধ আইন প্রথা মেনে চলে। যদিও জনগণের কল্যাণ মূলত আইনের উদ্দেশ্য তবুও সব সময় সর্বক্ষেত্রে আইন ন্যায়বিচার ও নীতির উপর অটল থাকে না। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে আইনের দৃষ্টিতে সমান এই কথাটি সকলে বললেও মূলতঃ তা পুরোপুরি সঠিক নহে। যদিও আইন কোন ব্যক্তি বা বিশেষ মোকদ্দমার জন্য প্রণীত হয় না তবুও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্হায় আইনের শাসন ও মানবাধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নিজকে সভ্য করার চেষ্টা করছিল সেই আদি কাল থেকে যা এখনও নিরন্তর। আদিকালে মানুষের ভাষাজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ সব সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সে যুগের মানুষকে বর্বর বা অসভ্য ভাবা হলে ও তারা বর্তমানে এক শ্রেণীর মানুষের মত অমানবিক ছিল না। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাÐ তাই প্রমাণ করে।
পৃথিবীতে যুগে যুগে নবী রাসুল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল অসভ্য বর্বর মানুষকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে মানবিক হতে শিক্ষা দেয়া। বাংলাদেশ সহ যে কোন দেশের উন্নয়ন কখনও টেকশই হতে পারে না যদি সে দেশের মানুষ সভ্য ও মানবিক না হয়। কোন দেশে যদি মানবতা মানবাধিকার গুম, খুন, জুলুম একক আধিপত্য, বিরোধী মতবাদকে উপেক্ষা করা হয় তখন ঐ দেশের গণতন্ত্রান্তিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়। যা কখনও কাম্য নয়। মানবাধিকার বলতে এমন কিছু অধিকারের সমষ্টিকে বুঝায় যা একজন মানুষ সমাজে বসবাস করলে স্বাভাবিক ভাবে সে যা লাভ করে সে অধিকার যা অ-হস্তান্তর যোগ্য, অক্ষয়, ও অন্তনির্হিত থাকে।বিভিন্ন গবেষণায় মানবাধিকারের যে তত্ত্বসমূহ দেখা যায় তম্মধ্যে প্রকৃতিবাদী মতবাদ, প্রত্যক্ষবাদী মতবাদ ঐতিহাসিক মতবাদ ও সমাজতাত্তিক মতবাদ মুলত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সমাজতাত্বিক মতবাদের মূল উপজীব্য মানুষ তাই এই মতবাদ অনুযায়ী আইন প্রণয়নের পদ্বতি হচ্ছে সমাজকে নতুনভাবে নির্মাণ করা। সমাজকে বিনির্মানে প্রতিটি জাতি গোষ্ঠির ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের যে রূপ বর্তমানে রয়েছে তা পাশ্চাত্য সভ্যতারই ফল। অন্যদিকে বিশ্বের কিছু ধনী রাষ্ট্রের নিছক স্বার্থের কারণে আজ বিশ্ব মানবতা হুমকির মুখে পড়েছে।বর্তমান বিশ্বে মানবতা একটি নিছক একটি ভন্ডামিতে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর জাতিসংঘ সর্ব প্রথম মানবাধিকারের সার্বজনীন মানদন্ড প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে ১৯৪৮ ১৯৬৬ সালে গৃহীত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা (টউঐজ), নাগরিক রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ (ওঈঈচজ) অর্থনৈতিক সামাজিক সংস্কৃতি অধিকার সংক্রান্ত সনদ (ওঈঊঝঈজ) যা জাতিসংঘেরই অবদান। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ও মানবাধিকার বাস্তবায়নে মানুষের যে সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে তা আজ উপেক্ষিত। যেমন- আইনের দৃষ্টিতে সমতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, প্রতিকার পাওয়ার স্বাধীনতা ইত্যাদি। অন্যদিকে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আদালতের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে যে দেশের আদালত ক্ষমতাসীনদের আধিপত্যের বেড়াজালে বন্দি থাকে সে দেশের মানুষ যে কত অসহায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মানবতা যদি কখনও হুমকির মুখে পড়ে ঐ মুহ‚র্তে উন্নয়ন হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক অবক্ষয় হয়। সমাজ কলুষিত হয়, ধ্বংস হয় রাষ্ট্র, নীরবে কাঁদে মানবতা। বর্তমানে মানবতা, মানব সভ্যতা ও মানবাধিকার এই তিনটি আলোচিত বিষয় হলে সামাজিক প্রেক্ষাপটে তা আমাদের দেশে অবমূল্যায়িত হচ্ছে। সমাজ রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জতিক ভাবে মুখে যতটা মানবতার কথা বলা হয় বাস্তবে এর কোন মিল নেই। মানবতা প্রকৃতভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বার্থের বলয়ে নিষ্পেষিত হচ্ছে। মানবতা হচ্ছে সেই মানবিক গুণাবলী যার পরশে পরশে জাগ্রত মানবিক চেতনা ধারণ করে স্বার্থের বলয় থেকে বেরিয়ে জন মানুষের কল্যাণে ভূমিকা রাখা। যে কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে সমাজ সভ্যতা আধুনিক মূল্যবোধ নতুনভাবে গড়ে উঠে, মূলত সেটিই ধারন করাই মানবতা বা মানব সভ্যতা।
মানবাধিকার বলতে একজন মানুষের তথ্যের অধিকার, ভোটাধিকার, স্বাধীন মত প্রকাশ, বেঁচে থাকার অধিকার এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত মৌলিক অধিকারকে বুঝায়। বেচে থাকার জন্য সব মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাÐসহ যাবতীয় অধিকার সহজে ভোগ করার নিশ্চয়তাই এক কথায় মানবাধিকার। বর্তমানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ক্ষমতা দখল, ভোটাধিকার হরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, সীমান্তে হত্যাকান্ড, বিশ্ব বিদ্যালয় সহ সর্বত্র দখলের রাজনীতি, হত্যার বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি, সাংবাদিক হত্যাকান্ড, রাজপথে হত্যা ও লাশের উপর নৃত্য, সর্বত্র ধর্ষণ, অর্থ, সুদ, ঘুষ, দুুর্নীতি মানবতা বর্জিত কর্মকান্ড প্রতিটি দেশের জন্য মানবতার জন্য এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। বর্তমানে দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী গ্যাসের মূল্য-বৃদ্ধি, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড হয়রানীমূলক মামলার কারণে সাধারণ মানুষ এখন নানারকম অশান্তিতে থেকেও ভয়ে নিরব ভুমিকা গ্রহণ করছে এই ছাড়া প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, মাদক, যৌতুক, খাদ্যে ভেজাল যা অস্বাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে মুলত তা এক শ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়িদের অসাধু মনোভাব রাজনৈতিক দৈন্যতা, রাজনীতিকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা অবৈধ ভাবে আয় করার মানসিকতা নৈতিক অবক্ষয় মানুষকে দিন দিন অমানবিক করে তুলছে। মনে রাখতে হবে মানবতা পরিপূণর্ভাবে প্রয়োগ করতে পারলে সমাজ, দেশ উপকৃত হয়। সবার অন্তরে মানবতা থাকে তবে তা স্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ। যে মানুষ থেকে মানবতার সৃষ্টি সেই মানুষই মানবতার ধ্বংসকারী। সর্বক্ষেত্রে একজন মানুষ এখন একজন আরেক জন মানুষের সবচাইতে দুর্বল দিকটি খুঁজে ও সুযোগ বুঝে আঘাত করা যেন সেইটি তার ধর্ম।
বর্তমানে দেশে মানবসেবা, মানবাধিকার নামে যে সব সংগঠনগুলো রয়েছে তাদের নীতি অনুযায়ী তারা কাজ করে না অন্য কিছু করে সেই প্রশ্ন সমাজে রয়েছে। শহরে, গ্রামে মানবতাপ্রেমী ব্যক্তির উপস্থিতির আজ জোয়ার নেমেছে। তারা কোন মাহফিলে সামান অর্থ দেয়ার কারণে তাকে সমাজসেবক উপাধি দেয়া হচ্ছে? যা ঠিক নয়। এমনভাবে যদি সমাজসেবক মানবতাবাদী মানবতাপ্রেমী ব্যক্তির উদ্ভব ঘটে তবে একসময় প্রকৃত মানবতাপ্রেমী ও সমাজসেবককে চিহ্নিত করা অনেকটা মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে পড়বে। মূল কথা এই সমাজে যার ক্ষমতা ও অর্থ নেই সে প্রকৃত বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য আইন ও বিচার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে সচেতন থাকতে হবে। ভুয়া মানবাধিকার সংস্থাগুলো আইনের আওতা আনতে হবে অন্যথায় মানুষ পথে পথে প্রতারিত হবে। বর্তমানে এমন কিছু লোক আমাদের সমাজে বিরাজমান যারা কিছু অর্থের বিনিময়ে অর্থ দাতাকে সমাজসেবক,মানবাধিকার নেতা, শিক্ষাবিদ সহ বিভিন্ন উপাধি দিচ্ছে। এইভাবে যদি শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক, মানবতাবাদী লোকের সমাগম ঘটে তখন মানবতাপ্রেমী ওপ্রকৃত সমাজ সেবককে চিহ্নিত কষ্টসাধ্য হবে।কাজেই প্রচার নয় সত্যিকারের মানবতাকে জাগ্রত করে প্রত্যেক মানুষ দেশের মানুষের কল্যাণে সকল মতের ঊর্ধ্বে উঠে মানবসেবার মনোভাব নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : আইনজীবী