মানবজীবনে সাহিত্য পাঠ ও গ্রন্থাগারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত

98

সর্বস্রষ্টা, সর্বদ্রষ্টা, পরম দয়ালু, সর্বশক্তিমান ইত্যাদি আসমাউল হুসনার অধিকারী মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এই সুন্দর ধরণীর সবচেয়ে ম‚ল্যবান সম্পদ, যা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও একই রূপে আবহমান ধারায় ছিলো, আছে এবং থাকবে সেটা হচ্ছে “শিক্ষা”। জ্ঞান,কর্মদক্ষতা, চারিত্রিক গুণাবলি ইত্যাদি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই সম্পদ অবশ্যই মানবজীবনে প্রয়োজন। এই ম‚ল্যবান সম্পদ অর্জন করতে হলে প্রথমত প্রয়োজন; সাহিত্যপাঠ বা বই পাঠ। দ্বিতীয়ত; সাহিত্য সাধনা করে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ গঠানো। একজন ব্যক্তি যদি নিজের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক গুণাবলি বা বিষয়াবলী সম্পর্কে জানতে, বুঝতে বা নিজের ক্ষমতা-অক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হতে চাই, তাহলে সাহিত্য সাধনার বিকল্প নেই। মানব আর মানব বিপরীত প্রজাতি বা পশুর মধ্যে প্রভেদ তৈরী হয়, জীববৃত্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তির কারণে। অর্থাৎ, পশুর মধ্যে থাকে জীববৃত্তি। আর মানবের জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি উভয় উপস্থিত থাকায় এই বিশ্বভ্রমান্ডে মানবজাতি হিসেবে বা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট জীব গুলোর মধ্যে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পরিগনিত।
বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ একমাত্র শিক্ষার আলোকে সাহিত্য সাধনা করে ঘটানো সম্ভবপর হয়। বাংলার একটা প্রবাদ লক্ষণীয়- “জ্ঞানহীন মানুষ পশুর ন্যায়”। তাহলে আমরা এই যুক্তিকতায় উপনীত হতে পারি যে, শুধু জীববৃত্তি থাকলে মানব হওয়া যায়না। সেখানে জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি উভয় বিদ্যমান থাকতে হবে। জ্ঞান উপস্থিত থাকলেই একজন মানুষ তার জাগতিক ও সাংসারিক ইত্যাদি ধাপ গুলোর মধ্যে নদীর স্রোতের মতো চলে আসা সংগ্রাম গুলোকে অনায়াসে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু এই জ্ঞান আহরণে বা বিস্তৃতিতে সবচেয়ে বেশী ভ‚মিকা রাখবে সাহিত্য পাঠ বা বই পাঠ। সাহিত্য সাধনায় তৎপর হলে তা জ্ঞান সৃষ্টিতে সহায়ক এবং জ্ঞান আহরণ করতে পারলে তা শিক্ষার পরিধিকে বিস্তৃত বা বিকশিত করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদি আমরা, শিক্ষার পরিধির সাথে কোনো কিছুর তুলনা বা মতবাদ সৃষ্টিতে প্রয়াসী হই, তাহলে সেই তুলনার বা মতবাদের কেন্দ্রবিন্দু হবে ‘মহাসাগর’ নামক ‘জলরাশি’। কেননা, মহাসাগর এমন এক জলের সমাহার বা জলরাশি; যার প্রবেশদ্বার রয়েছে ঠিকই। কিন্তু এর কোনো পরিসমাপ্তি আদৌ কি আছে? সেই প্রশ্ন সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রশ্নই রয়ে গেলো। তদ্রæপ শিক্ষার শুরু রয়েছে এর কোনো শেষ সীমারেখা নেই এবং শেষ শব্দটা শিক্ষার পরিধির সাথে মেলবন্ধন ঘটায়না।
মোদ্দা কথা,মহাসাগরে বিচরণ করতে হলে যেমন জাহাজ নিয়ে বিচরণ করতে হয়। তেমনিভাবে শিক্ষার ভিতরে বিচরণ করতে হলে সাহিত্য সাধনা সঙ্গে নিয়ে বিচরণ করতে হবে। তাহলেই শিক্ষার অভ্যন্তরীণ রস বা স্বাদ উপভোগ করা যায়। অতএব উপলব্ধির বিষয় এই যে, মানবজীবনের ম‚ল্যবান রতœ শিক্ষা আর শিক্ষার মূল্যবান রত্ন বই। একমাত্র বই পাঠ করে মানবজীবনকে পুষ্পিত করা সম্ভব। এই বই পাঠ নিয়ে অনেক মনীষী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সাহিত্যবিশারদ বা সাহিত্যবেত্তা ও কবিগণ সহ অনেকে অনেক যুক্তিকতা দেখিয়েছেন এবং তাদের সেই যুক্তিকতা বা দিক-নির্দেশনা বা প্রামাণিক আলোচনা সর্বকল্যাণকামী। বই পাঠ নিয়ে মুসলিম মনীষী ওমর খৈয়াম কবিতার আলোকে যথার্থই বলছেন- “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে,প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে। কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা-যদি তেমন বই হয়”।।
এই থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে,ভালো মানের বই হলে বা যেই বই পাঠ করলে সঠিক দিক-নির্দেশনা এবং জ্ঞানের পরিধি স¤প্রসারিত হয় সেই বই পাঠ করবো বা করা প্রয়োজন। কিন্তু এই বই পাঠ বা সাহিত্য সাধনার জন্য সবচেয়ে বেশী যে কেন্দ্রস্থল বা ক্ষেত্র প্রয়োজন,তা হলো গ্রন্থাগার বা পাঠাগার। বস্তুতপক্ষে ; কোনো কাজ করতে গেলে ভালো পরিবেশের দরকার বা ভালো সরঞ্জামাদির দরকার হয়। তদ্রæপ, চিন্তা শক্তিকে জাগ্রত, সঠিক দিক-নির্দেশনা, আত্মঅভিজ্ঞতা, জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহা এবং সা¤প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ বহির্ভ‚ত সাহিত্য সাধনায় একনিষ্ট ব্যক্তি বা ঐরূপ সমাজ এবং রাষ্ট্রদ্বয়ের জন্য সবচেয়ে বেশী যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে গ্রন্থাগার বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কেন্দ্র সৃষ্টি করা এবং গুরুত্বের সাথে এগুলোকে অর্থবহ করে তোলা। গ্রন্থাগারে বা পাঠাগারে একজন ব্যক্তি নিজ মনোনশীলতার সাহচর্যে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে নিজেকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাখে। যেখানে মনের আগ্রহানিতভাবে বা উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শিক্ষা অর্জিত হয়, সেখানে বা সেই প্রতিষ্ঠানে আমাদেরকে প্রবেশ করতে হবে।
আর বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে বলতে গেলে সেই তাৎপর্যপ‚র্ণ প্রতিষ্ঠানটি হতে পারে গ্রন্থাগার বা পাঠাগার। পাঠাগারে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত বই পাঠ করে নিজ জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত বা বিকশিত করা যায়।স¤প্রতি এই দেশে সচরাচর বা নিত্যনৈমিত্তিক বা লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, আজকাল স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা বা আমরা যে বিষয়টা নিয়ে অধ্যয়ন করি, ঠিক সেই বিষয়টা সম্পর্কে পারদর্শী হয়ে উঠি। কিন্তু এই বয়সে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হয়। তত্ত¡, তথ্য, মতবাদ, বিভিন্ন কবি ও লেখকগণের ভিন্নধর্মী বই পাঠ বা সাহিত্য সাধনায় নিজেকে আকন্ঠ নিমজ্জিত রাখতে হয়। যা এই দেশের ক্ষেত্রে হচ্ছেনা। তারও একটা বিশদ, বিশেষ কারণ প্রত্যক্ষ। তা হলো গ্রন্থাগার বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে আমরা আজ পশ্চাতপদ।
একজন লেখক তাঁর সৃষ্টিশীলতা বা সৃজনশীলতা সৃষ্টি বা সৃজনে বা প্রয়োগে তৎপর হন পাঠকের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পাঠকের অভাব যখন ‘টপ লেভেলে’ থাকে,তখন লেখকও তাঁর লেখনী বা সৃজনশীলতা নিয়ে অনাগ্রহ বা উদাসীনতা বোধ করেন। আবার পাঠকও যদি সুষ্ঠু পরিবেশ,নিজেকে শিক্ষার ভিতরে বিলীন করে দেওয়া মতো এবং জ্ঞান আহরণের কোনো উপযুক্ত পরিবেশ না পায়, তাহলে তাদের দোষ দেওয়া বাঞ্চনীয় নয়।
তাই সার্বিক বিশ্লেষণে,একটি রাষ্ট্রের জন্য পাঠাগার বা গ্রন্থাগার কতটা গুরুত্বপ‚র্ণ তা বুঝতে কষ্ট হয়না। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতির বা অগ্রগতির প্রথম ধাপ হচ্ছে শিক্ষা। আর শিক্ষার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গ্রন্থাগার/ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা। সুনাগরিক, সুশীল সমাজ, সুশাসন, সামাজিক শৃঙ্খল যোজন,অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনীতি চর্চা, গণতন্ত্র চর্চা এবং মুক্ত বুদ্ধির বিকাশ ইত্যাদি ভালোভাবে একটি রাষ্ট্রে বিকশিত করার শতভাগ (১০০%) উপযোগী ক্ষেত্র বা মাধ্যম হবে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা। তাই এখন থেকে স্থান, কাল, পাত্রভেদে এবং পরিবেশের কথা বিবেচনা করে, বেশী বেশী পাঠাগার/ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং পাঠাগার গুলোকে জনমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। এতে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সকল নাগরিক উপকৃত হবে।