মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে একটু দৃষ্টি দিন করোনায় গণমাধ্যম এবং সংবাদকর্মীদের দুরবস্থা

62

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

বিশ্বজুড়ে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি লাখো-কোটি মানুষ। করোনা ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ ও বিস্তার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে। করোনার কারণে আধুনিক সভ্য জগতের মানুষেরাই আজ সবচেয়ে বড় অসহায় এবং চরম বিপর্যস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পঁচাত্তর বছরেও এ রকম মানবিক বিপর্যয় কখনো দেখেনি মানুষ। প্রায় ১৮০ দেশের বড় বড় শহর, নগর ও জনপদে চলছে লক ডাউন। মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছে স্থবির ও স্তব্ধ। দেশে দেশে গরিব নিম্ন আয়ের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা আজ হুমকির মুখে। কাজ কর্ম ও জীবিকার পথ হারিয়ে দেশে দেশে গরিব-মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। কাজ নেই, খাবার নেই, চিকিৎসা নেই- সবখানে শুধু নেই নেই অবস্থা। বিশ্বজুড়ে ঘরে ঘরে চলছে আজ নীরব আর্তনাদ ও আহাজারি। লক ডাউনের ফলে ঘরে অবরুদ্ধ মানুষ ধুঁকে ধুঁকে চরম অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে। জীবিকার সকল পথ আজ বন্ধ। ফলে গরিব মানুষের কর্মহীনতা ও অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনে নেমে এসেছে গভীর দুর্দশা। গণমাধ্যমকর্মীদের অবস্থা আরো শোচনীয় ও করুণ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গত ২৫ মার্চ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে আপনি সবাইকে ঘরে থাকার এবং প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হতে যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেনÑ তা দেশবাসী নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। এই দুর্যোগেও গণমাধ্যমকর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। জনগণের দোরগোড়ায় তথ্য সেবা পৌঁছে দিতে দেশে হাজার হাজার গণমাধ্যমকর্মী আজ গভীর প্রতিক‚লতার মাঝেও নিজ নিজ কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। গণপরিবহন বন্ধ। যোগাযোগ ব্যবস্থাও বন্ধ- তবুও জীবনের ঝুঁকি ও বিড়ম্বনা নিয়ে জনগণের প্রতি দায় ও দায়বদ্ধতা থেকে এবং পেশার প্রতি সনিষ্ঠ থেকে গণমাধ্যমের (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন) হাজার হাজার সাংবাদিক আজ কাজ করে যাচ্ছে। সব সাংবাদিক যে ভালো বেতন পান, তা বলা যাবে না। বরং সীমিত বেতন-ভাতা দিয়ে অনেক সাংবাদিক পরিবার পরিজন নিয়ে টানাপড়েনে দিন পার করে থাকেন। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে বেশ সাংসারিক ধকল সইতে হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীদেরকে। অনেক সাংবাদিক গণমাধ্যমে মূল দায়িত্বে নিবেদিত থাকার বাইরেও একটু সচ্ছলতার আশায় টুকটাক নানা কাজে রত থাকেন। বর্তমানে তাও বন্ধ। করোনা পরিস্থিতি অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো সাংবাদিকদেরও সীমাহীন দুর্দশা ও বিড়ম্বনা দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে। সংবাদপত্র শিল্পে দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তা। আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা আজ গভীর উৎকণ্ঠা ও হতাশায় দিন পার করছি। সংবাদপত্রের বিপণন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বিজ্ঞাপনই সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের আয়ের বড় উৎস। বিজ্ঞাপন ও আয়ের পথ হারিয়ে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমগুলো আজ গভীর সংকটে পড়েছে। এমন করুণ পরিস্থিতি অতীতে কখনো দেখা যায় নি। কীভাবে চলছি, কীভাবে আগামী দিনগুলো পার করবÑআমরা গণমাধ্যমের কর্মীরা, তা ভবিতব্যই জানেন। করোনা দুর্যোগে আমরা গণমাধ্যমকর্মীগণ আজ চিড়ে চ্যাপ্টা। আমাদের জীবন তরী আর চলছে না। আমরা সীমাহীন প্রতিক‚লতা আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমরা গণমাধ্যমকর্মী হাজার হাজার সাংবাদিকদের দিকে একটু মানবিক দৃষ্টি দিন। আমাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা বা বিশেষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। সংবাদপত্র শিল্প, গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীদের চরম দুরবস্থা লাঘবে আমরা আপনার বিশেষ পদক্ষেপ কামনা করছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা হিসেবে আজ দেশের হাল ধরে আছেন। আপনার নেতৃত্বে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। পোশাক শিল্পে কর্মরত লাখো লাখো কর্মীকে বাঁচাতে আপনি পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। গরিব, অসহায়, অসচ্ছল ও নিম্ন আয়ের মানুষদের বাঁচাতে আপনি ছয় মাসের খাবার এবং নগদ আর্থিক সাহায্যের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- তাতে সবাই খুশি। চলমান মুজিববর্ষে দেশের একজন গরিবও গৃহহীন থাকবে না, সব গৃহহীন মানুষকে আপনি ঘর-দোর বানিয়ে দেবার সরকারি কর্মসূচির কথা বলেছেন। তাতে লাখো-কোটি গরিব মানুষ আজ আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। ইতোমধ্যে হাজার হাজার গরিব মানুষকে আপনি ঘর দোর বানিয়ে দিয়ে নজিরবিহীন দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো অসহায় বিপন্ন গরিব মানুষের প্রতি আপনার দরদ, মমত্ব ও ভালোবাসার কথা স্বীকার করতেই হয়। আপনার গতিশীল নেতৃত্বে আমরা উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুও আজ কোনো অলীক স্বপ্ন নয়। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও একক প্রচেষ্টায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে উপনীত। আমরা চাই, বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে দেশ আগামী দিনে আরো বহু দূর এগিয়ে যাবে।
গণপরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকায় গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দুর্ভোগ সয়ে জনগণের কাছে তথ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু আয় হয়ে পড়েছে সংকুচিত। ২০ টাকার রিকশা ভাড়ার স্থলে দ্বিগুণ তিনগুণ ভাড়ায় তারা কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করছে। অনেক গণমাধ্যম কর্মী মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে যাচ্ছে-আসছে। অনেকে আবার গভীর রাতে বাসায় ফিরছে চরম ঝুঁকি নিয়ে। গভীর রাতে রাজপথে তখন পুলিশ ও কুকুর ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। দেশবাসী এবং জনগণের জন্য সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের এই যে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার- তা কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। এই বৈরী পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র মালিকদের সংস্থা ‘নোয়াব’ (নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) সরকারের কাছে যে বিশেষ প্রণোদনা চেয়েছে তা অত্যন্ত যৌক্তিক ও প্রত্যাশিত। সংবাদপত্রের বেচা-বিক্রি ৯০ ভাগ কমে গেছে এই প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে। বিজ্ঞাপন তো শূন্যের কোটায় নেমেছে। তাহলে আগামী দিনে সংবাদপত্র, গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের কী অবস্থা দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নানা দুর্ভোগ-দুর্যোগ সয়ে সারা দেশে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে কর্মরত সংবাদকর্মীদের দিকে একটু মানবিক দৃষ্টি দিন। তাদের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করুন। আপনার সিদ্ধান্তে কয়েক বছর আগে গঠিত সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে সংবাদকর্মীদের দেওয়া অনুদান আরো বাড়ান। সারাদেশে জরিপ চালিয়ে বেকার ও কর্মক্ষম সংবাদকর্মীদের জন্য মাসিক ভাতা বা এককালীন অনুদানের আওতা আপনি আরো বাড়াতে পারেন। অকালে বা নানা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া সাংবাদিকের পরিবারগুলোর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আপনিই নিতে পারেন। অসহায় বিপন্ন সংবাদকর্মীদের সন্তানের পড়াশোনার জিম্মাদারি নিতে পারেন একমাত্র আপনিই। এই সদিচ্ছা ও সৎ সাহস আপনার আছে বলে আমরা মনে করি। আপনার সময়োচিত সিদ্ধান্তে বাঁচতে পারে গণমাধ্যমগুলো। গণমাধ্যমকর্মীরা সুদৃঢ় প্রত্যাশা নিয়ে আপনার দিকে চেয়ে আছেন, আপনিই আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন। আমাদের জীবন যন্ত্রণা লাঘব করতে পারেন-একমাত্র আপনিই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
লেখক : সাংবাদিক