মাদক মাফিয়াদের বিত্তের পাহাড়ের খোঁজে দুদক

129

মাদক মাফিয়াদের মাদকের কারবার নয়; মাদকের কারবারের মাধ্যমে অর্জিত বিত্তের পাহাড়ের খোঁজে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিভিন্ন সংস্থা বা ব্যক্তির কাছ থেকে তালিকা ও অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করে সংশ্লিষ্টদের নামে নোটিশ পাঠাচ্ছে দুদক। এতে নিজের বা অন্য কারও নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিকানা সম্পর্কিত দলিলাদি নিয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তার কাছে হাজির হতে অনুরোধ করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে তথ্য গোপন বা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের প্রমাণ পেলেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করছে দুদক।
তবে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানের মুখে আত্মগোপনে চলে যাওয়া কিংবা দেশান্তরী হওয়া মাদকের মাফিয়াদের অনেকের নামে নোটিশ ইস্যু করেও সাড়া পায়নি দুদক। কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারানোর আতঙ্কে থাকা মাদক মাফিয়ারা নোটিশ পেয়েও দুদকের সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার কাছে হাজির হচ্ছেন না। নানা কৌশলে তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এ অবস্থায় দুদক নিজস্ব আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে।
জানতে চাইলে দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘তালিকভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকেই শুরু করেছি। ইতিমধ্যে তালিকার বেশ কয়েকজনের ব্যাপারে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ করে এনেছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা। কেউ কেউ প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনগুলো কমিশনের সভায় উপস্থাপনের পর কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুদক নিজস্ব আইনে মামলাও করেছে। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।’
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, দুদকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ে তালিকায় থাকা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের অন্তত দুই ডজন মাদক মাফিয়ার সহায়-সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য শ্রবণ ও গ্রহণে নোটিশ ইস্যু করলেও বেশিরভাগই হাজির হননি। বরং তারা বর্ণিত ঠিকানায় না থাকাসহ নানা কৌশলে তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বিগত ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে কদমতলী পোড়া মসজিদ এলাকার মোহিনী ট্রান্সপোর্টের মালিক মো. ইউসুফের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা করে দেড়শ’ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ লুৎফুল কবির চন্দনকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর লুৎফুল কবির চন্দন ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর মো. ইউসুফকে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য সময়সূচি নির্ধারণ করে নোটিশ দেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তিনি দুদক কার্যালয়ে হাজির হননি। একইভাবে র‌্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত অধুনালুপ্ত বরিশাল কলোনির মাদক মাফিয়া মো. ফারুকের ভাই মোহাম্মদ সেলিমের নামে গত ২০ মে নোটিশ ইস্যু করেন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জাফর সাদেক শিবলী। নোটিশে তাদের তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে ইয়াবা ও হুন্ডির কারবারের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে ২৮ মে দলিলাদিসহ হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদান করতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিন ভাইয়ের একজনও হাজির হননি। এছাড়া দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-এর উপ-পরিচালক মাহবুব আলম, সহকারী পরিচালক হুমায়ুন কবির ও উপসহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিনকে কক্সবাজার-টেকনাফ অঞ্চলের মাদক ব্যবসায়ীদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে আত্মগোপনে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ভাই মাদক মাফিয়া মুজিবুর রহমান ও আব্দুস শুক্কুরের নামে-বেনামে ১০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের সম্পদের তথ্য মিলেছে। দুদকের কাছে তাদের দাখিল করা সম্পদ বিবরণী যাচাই চলছে। একইভাবে টেকনাফের আরেক মাদক মাফিয়া সাইফুল করিমের বিরুদ্ধেও দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রায় ১১ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। গত ৩০ মে দিবাগত রাতে টেকনাফ স্থলবন্দরের সীমানা প্রাচীরের শেষ প্রান্তে নাফ নদীর তীরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অন্যতম হোতা সাইফুল করিম নিহত হন। আর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে টেকনাফের আরেক মাদক মাফিয়া মো. আমিনের (৪২) বিরুদ্ধে গত ১৯ জুন মামলা করেছে দুদক।
সংস্থাটির সমন্বিত কার্যালয়ের উপ সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন ডবলমুরিং থানায় বাদি হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। মো. আমিন কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার মোহাম্মদ আলীর ছেলে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ৩২ লাখ ২৯ হাজার তিনশ’ ৫৩ টাকার স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করেন ও মিথ্যা তথ্য প্রদান করেন। সেখানে ছয় কোটি ৩৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮৪ টাকার স্থাবর বা অস্থাবর সম্পদ তার আয়ের উৎসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
অনুসন্ধানকারী সূত্র জানিয়েছে, বরিশাল কলোনিতে র‌্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাদক মাফিয়া মো. ফারুকের তিন ভাই মো. সেলিম, মো. শুক্কুর ও মোক্তার সৌদি আরবে কয়েক কোটি টাকা পাচার করে সেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। দুই ভাই দেশেই থাকেন। পটিয়ার ধলঘাটের নন্দেরখীলে প্রাসাদোপম বাড়ি ছাড়াও পটিয়া সদর ও নগরীতে ফারুকের স্ত্রী ফারজানাসহ ভাইদের নামে মার্কেট এবং একাধিক দোকান ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া দুটি কাভার্ডভ্যানও রয়েছে তাদের মালিকানায়।
উল্লেখ্য, দুদক আইন অনুযায়ী দুর্নীতি, প্রতারণা, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অভিযোগে দেশের যে কোনও নাগরিকের আবাসিক ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আস্তানা তল্লাশি করতে পারেন দুদকের কর্মকর্তারা। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অবৈধ যে কোনও বস্তু এবং সম্পদ জব্দ করতে পারেন তারা। আদালতের অনুমতি নিয়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তও করতে পারেন অবৈধ সম্পদ। অনুসন্ধানকালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতাও তাদের রয়েছে।
অনুসন্ধানে যারা অবৈধ সম্পদের মালিক বলে বিবেচিত হবেন, তাদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার বিধানও দুদক আইনে রয়েছে।