মাদক পাচার বন্ধে সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে 

59

সমকালীন আলোচিত এবং ভয়ঙ্কর ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার। দীর্ঘ বছর ধরে কক্সবাজার-টেকনাফ সীমান্ত দিয়েই বাংলাদেশে মাদকসহ অস্ত্র পাচারের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। বলা যায়, বাংলাদেশের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার যাবতীয় উপাদান এ মিয়ানমারই অবৈধপথে পাচার করছে। ফলে সরকার দেশে এ মাদক প্রতিরোধে নানা পন্থা অবলম্বন করলেও গোড়ায় গলদ থাকায় তা কোনভাবেই প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় নি; এখন বরং বলা যায়, মাদক পাচার, বাজারজাত, বিক্রি ও সেবন তুলনামূলকভাবে বহুগুণ বৃদ্ধিই পেয়েছে।
সম্প্রতি মাদকের টেবলেট প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সহজে বহনযোগ্য করে ‘ইয়াবা’র যে ব্যাপক পাচার, বাজারজাত ও সেবন চলছে- তাতে সরকার ও দেশের সাধারণ মানুষ কেউ স্বস্তিতে নেই। দেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার-টেকনাফসহ এতদঅঞ্চলের প্রতিটি জনপদই জমজমাট চলছে ইয়াবার ব্যবসা। গতবছরের শেষ দিকে সরকার ইয়াবাসহ যাবতীয় মাদক ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেন্স নীতি গ্রহণ করে ব্যাপক ধরপাকড় এমনকি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্যেও ইয়াবা বা মাদক পাচার নিয়ন্ত্রণ হয়েছে বলে মনে হয় না। সম্প্রতি সরকার ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের সুযোগও করে দিয়েছে, কিন্তু এসময়ও আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখেছি, বিভিন্ন পরিবহনযোগে, নারী-পুরুষের পেটে, বায়ুপথে ইয়াবা টেকনাফ-কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রামে আসছে। এমনকি থানা পুলিশসহ স্থানীয় রাজনীতি-ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ইতোমধ্যেই স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী অনেক ব্যক্তির নাম ইয়াবা গডফাদার হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে, বেশ কয়েকজন আটকও হয়েছেন।
মাদক ব্যবসা বিস্তার রোধে সরকারের ঘোষিত নানা উদ্যোগ সত্তে¡ও ইয়াবা বাণিজ্যের ভিত নাড়ানো যাচ্ছে না। সমাজপতি, রাজনীতিক, পুলিশ সবাই যখন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েন, তখন ইয়াবা ঠেকানো যাবে কীভাবে ? গতকাল দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর টেকনাফে আলাদা নজরদারি দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একের পর এক বন্দুকযুদ্ধে শুধু টেকনাফেই নিহত হয় ৩৯ জন। আত্মসমর্পণ করেন ৬৩ জন মাদক ব্যবসায়ী। এরপর ইয়াবার রুট বদলসহ চালান বন্ধ হয়েছে বলে দাবি করে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এখনো পুরনো রুট দিয়েই আসছে ইয়াবা। আর এই কাজে সক্রিয় রয়েছে পুরনো সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন সদস্য।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের বেশিরভাগ সদস্য ইয়াবা বাড়ির খবর জানলেও অজানা কারণে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেন। তারা যদি এই রুটগুলো বন্ধ করে দিত তাহলে দেশে আর ইয়াবাই প্রবেশ করতে পারত না। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, দেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা কমবেশি ৭০ লাখ। তাদের অধিকাংশই ইয়াবায় আসক্ত। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসির মত অনুযায়ী, মাদক উদ্ধার হয় সাধারণত মোট ব্যবহারের ১০ শতাংশের মতো। সেই হিসাবে বছরে শুধু ইয়াবা বড়ি বিক্রি হয় ৪০ কোটির বেশি, যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি বড়ি গড়ে দেড়শ টাকা দরে)। এই বিপুল টাকার শক্তিতেই ইয়াবা ব্যবসা হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। জাতিসংঘের এ সংস্থাটির প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে পূর্বদেশে উল্লেখ করা হয়, মিয়ানমারে উৎপাদিত মাদক অতীতে থাইল্যান্ড হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তার লাভ করলেও বর্তমান প্রধান গন্তব্য চিন অভিমুখে। আর পাচারের প্রধান রুট হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কার্যত মাদকের ভিকটিমে পরিণত হয়েছে। দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী মাদকের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ মাদকসেবী হওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ভূমিকা বিশেষভাবে দায়ি। মিয়ানমারের ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’ যদি জিরোতে চলে আসে, তাহলে বাংলাদেশে ইয়াবার প্রবেশও অনেকাংশে জিরো হয়ে যাবে। আমরা এ বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বা চুক্তির ভিত্তিতে এ ভয়াবহ ইয়াবা পাচার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করি। যা একমাত্র সরকারের পক্ষেই সম্ভব।