মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ

79

মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বাংলাদেশে ২০১৮ সালে অন্তত ৪৬৬ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ এসেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে।
‘ক্রসফায়ারে নিহত: মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে সন্দেহভাজনদের ‘গুম’ করা এবং নিহতদের বিরুদ্ধে ‘ভুয়া প্রমাণ তৈরির’ও অভিযোগ আনা হয়েছে।
সোমবার এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি বলেছে, কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর এসব ঘটনার তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ যে ব্যর্থ হয়েছে, তাও উঠে এসেছে তাদের এই প্রতিবেদনে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতবছর মে মাসে এক অনুষ্ঠানে জঙ্গি দমনের মত ‘মাদক ব্যবসায়ী’ দমনে ‘বিশেষ অভিযান’ শুরুর কথা জানান।
ওই অভিযান সফল করতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা নিয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পরে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত এই ‘যুদ্ধ’ চলবে।
শুরুতে র‌্যাব এই অভিযানে থাকলেও পরে গোয়েন্দা পুলিশ, রেল পুলিশ, থানা পুলিশ এবং বিজিবিকেও মাদকবিরোধী অভিযানে দেখা যায়।
অ্যামনেস্টি বলছে, অভিযানের প্রথম ১০ দিনেই অন্তত ৫২ জন ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার’ শিকার হন। ২০১৮ সালে সারা দেশে নিহত হন অন্তত ৪৬৬ জন সন্দেহভাজন, যা আগের বছরের তিনগুণেরও বেশি।
আন্তর্জাতিক এ মানবাধিকার সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক দিনুশিকা দিশানায়েক বলেন, এই ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধে’ প্রতিদিন গড়ে অন্তত একজনের প্রাণ গেছে। বিশেষ করে যেসব ঘটনায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়নের সংশ্লিষ্টতা ছিল, তারা আইনের তোয়াক্কা করেনি।
সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, বিচার তো নয়ই। কাউকে কাউকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে স্বাজনরা তাদের বুলেটবিদ্ধ লাশ দেখেছেন মর্গে।
এসব ঘটনা তদন্তের উদ্যোগ না নিয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ দাবির পক্ষে ‘ভুয়া প্রমাণ’ তৈরির নির্দেশ দিয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে। খবর বিডিনিউজের
পুলিশ যাদের ওইসব ঘটনার ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ বলেছে, এরকম কয়েকজন অ্যামনেস্টিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারা নিজে চোখে ঘটনা দেখেননি। কিন্তু পুলিশ তাদের ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ হিসেবে তাদের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ দাবির পক্ষে বিবৃতি দিতে বলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ঘটনাগুলো নিয়ে অ্যামনেস্টি অনুসন্ধান চালিয়েছে, তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিকটিমকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কখনও একদিন, কখনও দেড় মাস পর তাদের লাশ পাওয়া গেছে।
একটি ঘটনায় একজন ভিকটিমের মুক্তির জন্য পুলিশকে ঘুষ দেওয়ার কথাও অ্যামনেস্টিকে বলেছে, তার পরিবার। কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি।
সরকার গতবছর মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করার পর সব পক্ষ থেকেই এ অভিযানকে সমর্থন দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এর প্রক্রিয়া নিয়ে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাগুলো নিয়ে সাধারণের মধ্যে সবসময়ই সন্দেহ রয়েছে। আর মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যা হিসেবেই বর্ণনা করে আসছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলোর যে বিবরণ দেয়, তার প্রায় সবই মোটামুটি এক। বলা হয়, সন্দেহভাজনরা প্রথমে গুলি চালালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘আত্মরক্ষার্থে’ পাল্টা জবাব দেয়। আর গোলাগুলির মধ্যে সন্দেহভাজন নিহত হয়।
পুলিশ যাদের এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সামনে আনে, তাদের কয়েকজনের সাক্ষাতকার নিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এরকম পাঁচজন কথিত প্রত্যক্ষদর্শী অ্যামনেস্টিকে বলেছেন, ঘটনার পর তাদের জোর করে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ হিসেবে বিবৃতি দিতে পুলিশের অনুরোধ তারা ভয়ে প্রত্যাখ্যান করতে পরেননি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নাম, ফোন নম্বর, ব্যক্তিগত তথ্য ও স্বাক্ষর রেখে দেয়।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৩৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির স্বজনদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, আট বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে ছাপড়া ঘরে থাকতেন ওই ব্যক্তি। জীবন ধারণের জন্য অনেক সময় তাকে তার ভাইদের ওপর নির্ভর করতে হত।
স্বজনদের দাবি, কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে ওই ব্যক্তি পরিবারকে ফোন করে বলেছিল, মুক্তির জন্য পুলিশ তার কাছে ২০ হাজার টাকা চেয়েছে। কিন্তু ওই টাকা দেওয়ার পর পুলিশ আরও ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। ওই ব্যক্তি পরিবারকে বলেন, টাকা না দিলে তাকে হত্যা করা হবে।
পরিবারের সদস্যরা ওই ব্যক্তির খোঁজে থানায় গেলে বলা হয়, তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ফোনে টাকা লেনদেনের আলাপের চার দিন পর পরিবারকে বলা হয়, ওই ব্যক্তি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে।
মাদককিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে পুলিশ ও র‌্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যাচাইয়ে দ্রুত, নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও কার্যকর তদন্ত শুরুর আহব্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
দিনুশিকা দিশানায়েক বলেন, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে মাদক নিয়ন্ত্রণ কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে যাতে মানুষের ক্ষতির বদলে সুরক্ষার ব্যবস্থা হয়।