মাত্র দুই ঘণ্টাতেই ৬ ধাপ পেরিয়ে বিশুদ্ধ হয় পানি

129

নদী থেকে পানি উত্তোলন করে সেটা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিশোধন করা হয়। এই পরিশোধন প্রক্রিয়ায় ৬টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে সে পানি দেয়া হয় পাইপলাইনে। নদী থেকে উত্তোলন ও পাইপলাইনে দেয়া পর্যন্ত সময় লাগে দুই ঘণ্টা। ওয়াসার মদুনাঘাটস্থ শেখ রাসেল পানি শোধনাগারে নদী থেকে তোলা পানি এই প্রক্রিয়াতে বিশুদ্ধ করেই সরবরাহ করা হচ্ছে নগরীতে। যে পানির মান বাজারে বোতলজাত পানির চেয়েও বেশি উন্নত।
হালদা নদী থেকে অপরিশোধিত পানি উত্তোলন করে পাঠানো হয় ইনটেকে। ইনটেকে যাওয়া পানি থেকে ভাসমান পদার্থ আটকে রাখতে ভাসমান ফেন্স ও বারস্ক্রিন ব্যবহার করা হয়। ইনটেক থেকে ইনলেট চ্যানেলের মাধ্যমে মূল পানি পাম্পওয়েলে প্রবেশ করে। সেখান থেকে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের প্রি-সেডিমেন্টশন বেসিনে আনা হয়। সেখানে ভারি মাটি, কাদা ইত্যাদি বিশেষ প্রক্রিয়াতে তলানিতে জমা পড়ে। বেসিন থেকে রিসিভিং ওয়েলে এসে লাইম ও এলাম মিশ্রণ করে ফ্লাশ মিক্সার হয়ে ফ্লোকোলেশন চেম্বারে প্রবেশ করে। এরপর সে পানি ক্ল্যারিফায়ারে প্রবেশ করে। ক্ল্যারিফায়ার থেকে পরিশোধিত হয়ে পানি ফিল্টারে আসে। ফিল্টারে পানি সম্পূর্ণ পরিশোধিত হয়। তারপর পরিশোধিত পানিতে ক্লোরিন মিশিয়ে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ক্লোরিন কনটাক্ট চেম্বারে প্রবেশ করানো হয়। পরে জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি ওয়েল থেকে ট্রান্সমিশন পাম্পের সাহায্যে দীর্ঘ ট্রান্সমিশন লাইন দিয়ে উচ্চচাপে পাঠানো হয় নগরীতে। এই পানি পুরোপুরি বিশুদ্ধ এবং সরাসরি পান করার উপযোগী।
১২ একর জায়গার উপর গড়ে তোলা শেখ রাসেল পানি শোধনাগারটি আগামীকাল রবিবার উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। ভিডিও কনফারেন্সের মধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন। প্রকল্পটি থেকে প্রতিদিন নয় কোটি লিটার পানি নগরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে। উদ্বোধন পূর্ববর্তী গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের নিয়ে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ। এসময় ওয়াসার বোর্ড সদস্য মহসিন কাজী ও ওয়াসার উধ্বর্তন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে নিয়ে কথা বলেন।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, প্রকল্প এলাকায় না আসলে বুঝা যায় না এখানে কি কর্মযজ্ঞ হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শেখ রাসেল পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এখানে পুরো প্রক্রিয়ায় তদারকি করা হয়। নদীর পানি পুরোপুরি বিশুদ্ধ করেই পাইপলাইনে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে পানির চাহিদা রয়েছে ৪২ কোটি লিটার। আর আমাদের সক্ষমতা রয়েছে ৩৬ কোটি লিটার। আমরা আরো দুটি প্রকল্পের কাজ হাতে নিচ্ছি। শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্পের ফেস-২ এর কাজ শুরু হয়েছে। শেখ রাসেল পানি শোধনাগার প্রকল্পেরও ফেস-২ শুরু হবে।
চিটাগং ওয়াটার সাপ্লাই ইম্পুভমেন্ট অ্যান্ড সেনিটেশন প্রজেক্টের অধীনে মদুনাঘাট প্রকল্পের কাজে হাত দেয় ওয়াসা। হালদা নদীর পানি পরিশোধন করে নগরীতে দিনে ৯ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। ১৮৯০ কোটি টাকার মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে। তবে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে। বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম ওয়াসার যৌথ অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এরমধ্যে বিশ্বব্যাংক ১ হাজার ৪৯৪ কোটি ৯০ লাখ, বাংলাদেশ সরকার ৩৭০ কোটি ৩৭ লাখ ও চট্টগ্রাম ওয়াসা ২২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে। প্রকল্পের পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের হাটহাজারীর মদুনাঘাট এলাকায়। মদুনাঘাট থেকে আসা পানি পাইপ লাইনের মাধ্যমে নগরীর কালুরঘাট বুস্টার স্টেশনে আসার পর সেখান থেকে মূল পাইপ লাইনের মাধ্যমে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হবে। প্রকল্পের অধীনে ১৩৫ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন বসানো হয়েছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হালদা নদী থেকে পানি উত্তোলনের পর পরিশোধন করে নগরীতে সরবরাহ করা। বিশেষ করে নগরীর উত্তর-পূর্ব অংশ বৃহত্তর বাকলিয়া, মোহরা, চান্দগাঁও, কালামিয়া বাজার, কল্পলোক আবাসিক, রাহাত্তারপুল, খাতুনগঞ্জ, খাজা রোড, ডিসি রোড, সিরাজ উদ দৌলা সড়কের পূর্ব অংশ এবং পতেঙ্গা এলাকায় পানি সরবরাহ করা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, আমরা হালদা নদী থেকে পানি উত্তোলন করি। তারপর এ পানি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করে কি পরিমাণ কেমিক্যাল মেশাতে হবে তা ঠিক করি। ক্যামিক্যাল মেশানোর পর ৬টি ধাপে পানি শোধন করা হয়। পানি শোধন শেষে সরবরাহ লাইনে দেওয়ার আগে আমরা ল্যাবে আবারও পরীক্ষা করি। এতে পানির সব মান ঠিক আছে কিনা যাচাই করা হয়। পরে তা সরবরাহ লাইনে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, হালদা নদী থেকে পানি উত্তোলন থেকে সরবরাহ লাইনে পানি দেয়া পর্যন্ত সময় লাগে দুই ঘণ্টা। এরমধ্যে পানির ময়লা, ক্ষতিকর সব কিছু অপসারণ করা হয়। শেষ ধাপে বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করেই সরবরাহ লাইনে পানি সরবরাহ করা হয়। তাছাড়াও প্রতিমাসে আমরা নগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে পানির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করি।
মাকসুদুল আলম বলেন, শেখ রাসেল পানি শোধনাগারের ৯ কোটি লিটার পানি এখন বহদ্দারহাট বুস্টার হয়ে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হচ্ছে। চকবাজার-জামালখান, সদরঘাট হয়ে পতেঙ্গা পর্যন্ত নতুন পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। নতুন পাইপলাইন হয়ে গেলে সাড়ে ৪ কোটি লিটার পানি সরাসরি পতেঙ্গা লাইনে দেয়া হবে।