মাঘ শেষের আগেই শীতের বিদায়?

85

ভরা মাঘে বাঘা শীত তো দূরের কথা, উত্তুরে হাওয়াও যেন কোনও উত্তর না দিয়ে ক্রমশ দাপট হারাচ্ছে। পতন-প্রবণতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই মাথা তুলতে চাইছে পারদ। মাঘ শীতের পরিপূর্ণ মাহাত্ম্য দেখানো আর তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে নিচে থাকার মাস হলেও বিরাজমান আবহাওয়া পরিস্থিতি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে না।
পৌষ সংক্রান্তির দিন থেকেই উত্তরাঞ্চলসহ দেশজুড়ে তাপমাত্রা ধারাবাহিকভাবে নেমে শীতের আমেজ হাজির করেছিল। তবে, চলতি শীত মৌসুমের শুরু থেকেই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে চট্টগ্রামেই। ফলে, এ অঞ্চলের বাসিন্দারা গোটা পৌষজুড়ে তো বটেই, মাঘের বিদায়ী দশদিনেও হাঁড়কাপানো শীতের কামড় অনুভব করেন নি। বিশেষ করে, শহরাঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে শীত এখন পর্যন্ত চেনারূপেই ধরা দেয়নি। গতকাল মঙ্গলবার ছিল মাঘের ৯ তারিখ। গতকালই চট্টগ্রামে পারদ চড়ে অতিক্রম করেছে তিরিশের ঘর। সন্ধ্যার পর বাইরে বাতাসে হালকা শীতলতা অনুভূত হলেও ঘরের ভেতর তো অনেকে বৈদ্যুতিক পাখার সুইচে চাপ দিতে রীতিমত বাধ্য হয়েছে। আর উত্তরাঞ্চলে মৌসুমের শুরু থেকে বয়ে চলা শৈত্যপ্রবাহও ক্রমেই পারদের ঊর্ধ্বমূখীনতায় দাপট হারিয়ে মাঝারি থেকে মৃদু মাত্রায় নেমেছে। গতকাল মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ দশমিক সাত ডিগ্রি ছিল কক্সবাজারে। আর মাঝারি থেকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহে উন্নীত হওয়া উত্তরের জনপদ তেঁতুলিয়ায় ছিল সর্বনি¤œ তাপমাত্রা। আক্ষরিক অর্থে যা ছিল আট দশমিক চার ডিগ্রি।
অধিকাংশ আবহাওয়াবিদ বলছেন, জলবায়ু বিদ্যা বা ঋতুচক্র মানলে শীতের বিদায় নেয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। বর্ষার মতো শীতের নির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট না-থাকলেও মাঘের মাঝামাঝি থেকেই শীতের জারিজুরি কমতে থাকে। কিন্তু, শীতের আচরণগত রহস্যময়তায় দ্বিধায় পড়েছেন আবহাওয়াবিদরা। মাঘের আগেই এবার শীতকে বিদায় জানানোর আয়োজন শুরু করতে হবে কিনা তাও তারা নিশ্চিত করে বলছেন না। তবে, বাসিন্দারা বলছেন, শীত এবার নেই হয়ে গেছে।
অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি তেঁতুলিয়ায় দুই দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা নেমে এসেছিল। ৫০ বছরের মধ্যে এটিই ছিল দেশের সবচেয়ে কম তাপমাত্রার রেকর্ড। এবারও ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে জানুয়ারি মাসে শীতের ধরন একইরকম হতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা পূর্বাভাস দিলেও ঠিক ততটা মিলেনি। পারদ চার ডিগ্রি নেমে আসার পূর্বাভাস দিলেও চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে পাঁচ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চলে বেশ শীত পড়েছিল। তখন উত্তরাঞ্চলে বয়ে যাওয়া তীব্র শৈত্যপ্রবাহ এখন মাঝারি অবস্থাও অতিক্রম করে মৃদু মাত্রায় বইছে। এ মাসের শেষদিকে আরও একটি শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস থাকলেও আলামতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখন বিষুবীয় ভারত মহাসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়েছে। এটি শীতের পথে কাঁটা বিছিয়ে দিচ্ছে।’
আবহাওয়াদিরা বলছেন, একদা শীতকালে দিনে প্রায়ই সূর্যের দেখা মিলত না। থাকত কনকনে ঠান্ডা। তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। বিপর্যস্ত জনজীবন। এটাই ছিল মোটামুটি শীতের পরিচিত চেহারা। কিন্তু চিরচেনা সেই শীত কোথায়? হাঁড়কাপানো শীতের কামড় ছাড়াই প্রথম পক্ষ অতিক্রম করতে চলেছে মাঘ মাস। এখন পর্যন্ত ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রেখেছে শীত! কনকনে শীতে কাঁপতে হয়নি দেশের সব অঞ্চলের মানুষকে। মাঝারি ধরনের শীত পড়লেও স্বাভাবিকের কাছেই ঘোরাফেরা করেছে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এ বছর শীত মৌসুমের গোড়াতেই বার বার হোঁচট খেয়েছে উত্তুরে হাওয়া। সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘ফেথাই’ ও ‘পাবুক’-এর বাউন্সার মোকাবেলা করতে হয়েছে উত্তুরে হাওয়াকে। ফলে, ডিসেম্বরেও শীত-শীত ভাবটা উধাও হওয়ার অবস্থা হয়েছিল। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে শীতের মাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও পূর্ববর্তী মৌসুমের মত মানুষের হাড় কাঁপাতে পারেনি। জানুয়ারিও শেষ হতে চলল। এই মাঘই কিনা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে এরইমধ্যে। তাপমাত্রা আর কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই তো উল্টো শুনতে হবে মৃদু তাপপ্রবাহের কথা। এবার তীব্র শীত ছাড়াই মাঘ মাসের বিদায় ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে। শীতের এই অকাল-বিদায়ের জন্য পশ্চিমা ঝড় এবং সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের যৌথ আবির্ভাবই দায়ী। ভারতের উত্তর প্রদেশের ওপর দিয়ে একটি পশ্চিমা ঝড়, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা, ভারি হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশের উপরে রয়েছে একটি লঘুচাপ। তার প্রভাবেই জলীয় বাষ্প ঢুকেছে। সেই জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তৈরি করছে মেঘ। আর তার ফলেই উত্তুরে হাওয়া বাধাপ্রাপ্ত গেছে। পুরো ব্যাপারটাই শীতের স্বভাববিরুদ্ধ। শীতকালে সাধারণভাবে আকাশ মেঘমুক্ত থাকে। ফলে দিনে ঝকঝকে রোদ পাওয়া যায়। মাটি গরম হয়। রাত হলেই সেই তাপ দ্রæত বিকিরিত হয়ে ঠান্ডা হয় মাটি। তার সঙ্গে উত্তুরে হাওয়ার যুগলবন্দীতে কনকনে ঠান্ডা পড়ে। কিন্তু শীতের সেই স্বাভাবিকতা এবার ধাক্কা খেয়েছে একেবারে গোড়া থেকেই। সূচনা পর্বে ঘূর্ণিঝড় তার চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছিল। তারপরও বাধা ডিঙিয়ে মাথা তোলার চেষ্টা চালিয়ে কয়েকদিন স্থির থাকতে পেরেছিল এই যা। কিন্তু সেই পথও কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমা ঝড় আর লঘুচাপ। হিমাচলে যতই বরফ পড়–ক, ঝড় ও লঘুচাপের কাঁটা বিছানো পথ সহজে সরানো সম্ভব হবে না। তার মানে তো এবার তাহলে মাঘের বিদায়ের আগেই শীতকে বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে!
আহাওয়ার গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশের তাপমাত্রা থাকে কাছাকাছি। ভারত উপমহাদেশে দেখা গেছে, বিগত ১৫ বছরের মধ্যে প্রায় ১৩ বছরেই তাপমাত্রা ছিল রেকর্ড পরিমাণ। ২০১৫ সালে সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে তাপমাত্রা বেশি ছিল। দেশে শীতকালে সূর্য থাকে দক্ষিণ গোলার্ধে। ২২ ডিসেম্বর হচ্ছে সবচেয়ে ছোট দিন। এই সময় সূর্য সবচেয়ে দূরে থাকে। এ কারণে ডিসেম্বরে তাপমাত্রা কম থাকে। ২২ ডিসেম্বরের পর থেকে সূর্য ধীরে ধীরে উত্তর গোলার্ধের দিকে যেতে থাকে। এভাবে জানুয়ারি পেরিয়ে ফেব্রæয়ারির প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। মার্চে গিয়ে তা অনেক বেড়ে যায়। এটাকে বলা হয়, জেট উইন। ইউরোপে সূর্য অনেক দূরে থাকে। রাতের তাপমাত্রা অনেক কম থাকে। এ সময় একধরনের বাতাস আসে, ওই বাতাস কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই চ্যানেল দিয়ে শীতের হিমেল হাওয়া উত্তরাঞ্চল চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, রংপুর হয়ে ধীরে ধীরে দেশজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে।