মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদীর জীবনাদর্শ ও সমকালীন বাংলাদেশ

122

প্রাককথা : ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকের শোষণ যন্ত্রণায় কাতর ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতাহারা দুর্ভাগা জনগন। এর মধ্যে মুসলমানদের অবস্থা আরো সূচনীয়। রাজ্য হারায় যাতনায় তাদের এমনভাবে পিছিয়ে দিয়েছে না পারছে ব্রিটিশ রাজভক্তি অর্জন করতে, না পারছে তাদের ষা-সংস্কৃতির মোহনীয় দর্শনটির অত্মস্ত করতে। অথচ হিন্দু সম্প্রদায় ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলেও রাজভক্তি ও ইংরেজি শিক্ষা এ দু’টিকেও সমানে সামলিয়ে নিচ্ছিলেন। পরবর্তীতে স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আবদুল লতিফ এবং স্যার সৈয়দ আমীর আলী মুসলমানদের উন্নতির জন্য শিক্ষা ও কিঞ্চিত রাজভক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে যে, সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন তাতে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে শুধু নবজাগরণের সুচনা হয়নি; পরবর্তী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের স্বক্বীয় রজনৈতিক দর্শন ও ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অবসানে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ তিন মুসলিম মনীষীর উত্তরসূরী হিসেবে মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয়, রজনৈতিক ও সামাজিক প্রথায় সনাতন রীতি কাটিয়ে একটি সফল সংগ্রামে নিজ জীবনকে উৎসার্গিত করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্যের বিশাল অংশজুড়েই ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের পতন ঘটিয়ে নৈতিক ও জনকল্যাণমূলক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার গোড়া পত্তন করা। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলা তথা চট্টগ্রামের এই কৃতি পুরুষটির জীবন কর্ম ও দর্শনের একেকটি অধ্যায় পাঠ করলে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। একজন আরবি শিক্ষিত মাওলানা তার স্বভাব সুলভ সংস্কারকে পদদলিত করে বাংলা তথা ভারতের জনগণ বিশেষতঃ মুসলমানদের আধুনিক সভ্যতায় উন্নীত করার সমূহ প্রয়াস তিনি করে যান। শিক্ষা, সাহিত্যে, সাংবাদিকতায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে, দুঃস্থ মানবতার সেবায়, নারী অধিকার উন্নয়নে, রাজনীতি ও সমাজ সংস্কার, উন্নয়ন এবং ইসলামী মিশনারিতে তার পদচারনা সপ্রতিভ ছিল সবসময়। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর বিপ্লবী চেতনা এখনও বাংলা ও পাক-ভারত উপমহাদেশের জনগণকে আন্দোলিত করে। তিনি তাঁর নিজের রচিত আত্মজীবনীর পদ্যাংশে বলেন-
“ষাটের উপর, আরও দশ বছর,
বৃথা কাটিয়া গিয়াছে আমার ওমর
দেশ-বিদেশ ভ্রমণে, সমাজ সেবায়,
রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য চর্চায়
ধর্ম প্রচার কাজে, আর শিক্ষা বিস্তার
সময় এসব কাজে কেটেছে আমার।
(মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী)
আত্মজীবন। (পরিশিষ্ট-১) পৃ.-১২১।
আমরা মাওলানা এছলামাবাদীর সামগ্রিক জীবন পর্যালোচনা করে তাঁর পঁচাত্তর বছর সময়কালকে মোটামুটি ছয় ভাগে বিন্যাস করতে পারি।
১। ১৮৭৫-১৮৯৮ (জন্ম, শৈশব, কৈশর ও শিক্ষা জীবন)।
২। ১৮৯৮-১৯০৩ (কর্মজীবন ও লেখা-লেখিতে আত্মনিয়োগ)।
৩। ১৯০৩-১৯২০ (সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সৃজনশীল কর্মকাÐে আত্মনিয়োগ)।
৪। ১৯২০-১৯৩৫ (রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাÐে আত্মনিয়োগ)।
৫। ১৯৩৫-১৯৪৬ (বিপ্লবী যুগঃ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, কারাবরণ, মুক্তি এবং খ্যাতি ও যশে শীর্ষস্থানে আসনগ্রহণ)।
৬। ১৯৪৬-১৯৫০ (অবসর সময়কাল ও চট্টগ্রামের নিজ গ্রামে শেষ নিঃশ্বিাস ত্যাগ)।
জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা জীবন: মাওলানা এছলামাবাদী ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে অক্টোবর মাসে ১২৩৬ মঘী ভাদ্র মাসের এক রবিবারে চট্টগ্রাম জেলা পটিয়া থানার অর্ন্তগত আরালিয়া (প্রকাশ আইল্ল্যারচর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুন্সী মতিউল্লাহ্ একজন শিক্ষবিদ ও পÐিত ছিলেন। তার পিতৃ পুরুষ ফতেহ মোহাম্মদ খাঁন তৎকালীন বাংলা রাজধানী গৌড়ের পাঠান সোলতান সৈয়দ হোসেন শাহ্রে পুত্র নুসরৎ শাহ্রে চট্টগ্রাম বিজয়ী জনৈক সেনাপতির বংশধর। চট্টগ্রাম শহর থেকে আট মাইল উত্তরে ফতেয়াবাদ (নুসরৎ শাহের চট্টগ্রাম বিজয়স্থল। বিজয়ের পর এই স্থানের নাম দেয়া হয় < ফতেহ্ + আবাদ >= ফতেহাবাদ। উপভ্রংশ ফতেয়াবাদ) গ্রামে বসবাস করে। পরবর্তী তাঁর পৌত্র খোশহাল মোহাম্মদ আরালিয়া জায়গীরে এসে বসবাস শুরু করেন এবং আরালিয়া চরসেবন্দী ও বাইনজুরী মৌজার জমিদারী লাভ করেন। মুসলিম বাংলার শাসক নুসরৎ শাহের সঙ্গী মাওলানা এছলামাবাদী পূর্বপুরুষ ফতেহ্ মোহাম্মদ খান আরবের আশরাফ শ্রেণীর লোক ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। সেই সুবাদে মাওলানা এছলামাবাদীর বংশীয় ঐতিহ্য সম্ভ্রান্ত ছিল নিঃসন্দেহে। ১৯৬০ খ্রি. আক্টোবরে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ঞযব ঊধংঃবৎহ ঊীধসরহধৎ পত্রিকায় মাওলানা ইসলামাবাদীর দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সম্পাদিকীয় নিবন্ধে বলা হয়Ñ গড়ঁষধহধ গঁহরৎুুঁধসধহ ওংষধসধনধফ’ং ভধসরষু যরংঃড়ৎু ংড় ভধৎ ঃৎধপবফ ফরংপষড়ংবং ঃযব ভধপঃ ঃযধঃ ড়ৎরমরহধষষু যরং ভড়ৎবভধঃযবৎং বিৎব ভৎড়স ধ হড়নষব ভধসরষু ড়ভ গরফফষব ঊধংঃবৎহ ঈড়ঁহঃৎরবং ধহফ ঃবসঢ়ড়ৎধৎরষু ংবঃঃষবফ ধঃ ঋধঃবযধনধফ ধৎবধ রহ ঈযরঃঃধমড়হম ফরংঃৎরপঃ (পৃষ্ঠা-৩) নঁঃ ড়হ ষধঃবৎ ুবধৎং কযধহ গড়যধসসধফ কযধহ ড়ভ ঃযব ভধসরষু ংযরভঃবফ ঃড় অৎধষরধ রহ চধঃরুধ চং. ঁহফবৎ ংধসব ফরংঃৎরপঃ ধহফ ংবঃঃষবফ ঃযবৎব ঢ়বৎসধহবহঃষু (মৌলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী রচনাবলী পৃ.-১৪)।
তার মায়ের নাম রহিমা বিবি। ১২ বছর বয়সে তিনি নিজ গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন শেষে ১৯৮৯ সালে হুগলী মাদ্রাসায় মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে মাদ্রাসায় সিনিয়র ডিগ্রি অর্জন শেষে কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসায় ১৮৯৬ সালে জামাতে ওলা (অধুনা ফাজিল) এবং ১৮৯৮ সালে টাইটেল (অধুনা কামিল) শ্রেণিতে কৃতিত্বের সাথে পাস করে মাওলানা উপাধী লাভ করেন। কিন্তু ১৯৭৯ সাল থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর যাবত মাওলানা এছলামাবাদী ইসলামি শিক্ষায় সর্বো”চ ডিগ্রি অর্জন করে মাওলানা খ্যাতি লাভ করলেও মানসিকভাবে মাওলানার স্বভাব সুলভ সংস্কার বলতে কিছুই ছিল না। তিনি ইসলামি জ্ঞানের মূল উৎস কোরআান ও হাদিসকে অথের্র বিনিময়ে বিক্রি করে ওয়াজ, নছিহত, জাড়-ফোকঁড়, ইত্যাদি কর্মকাÐ থেকে নিজেকে বিরত রেখে শিক্ষা ও সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে ব্যাপৃত করেন। ফলশ্রæতিতে দেখা যায়, তিনি শিক্ষা শেষে কিছুদিন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হয়ে ইসলামি শিক্ষার প্রচার-প্রসার ও ইসলামি মিশনারী কাজে আত্মনিয়োগক করেন। এ সময় মাওলানা এছলামাবাদী স্বাধীন রোজী রোজগারের জন্য হেকিমী চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যায়ন ও মোক্তারী শিক্ষায় ব্রতী হন। কিন্ত এই দুইটির কোনটিই কর্ম জীবনের পেশা হিসাবে গ্রহণ করেননি। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, মোক্তারী পেশায় তিনি যাওয়ার ই”ছা করলেও মাইজভাÐার তরিকার প্রবর্ত্তক গাউসুল আজম খ্যাত আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ (রা.) ইঙ্গিত পেয়ে এই পেশায় যাওয়া থেকে নিবৃত হন।
কর্মজীবন: এছলামাবাদীর কর্মযোগ হয়েছিল ১৮৯৮ সালে মাসিক তিন টাকা বেতনে কলকাতার একটি মসজিদের মোয়াজ্জিম ও ইমাম হিসাবে। এরপর রংপুর সদরে নিশিপাড়া জুনিয়ার মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পেশায় যোগদেন। এখানে ক্রমান্বয়ে তাঁর পদোন্নতি যশ ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। অল্পসময়ের ব্যবধানে চাকুরি ঝেড়ে মাওলানা ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে ছাগলের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস এক ভুমিকম্প জানিত জ্বলোচ্ছাসে তাদের ব্যবসায় প্রচুর ক্ষতি হয়। ফলে ব্যর্থ মনোরত ব্যবসা ছেড়ে আবারও শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়: তৎকালীন মাদ্রাসা শিক্ষায় ভূগোল, ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ে কোন শিক্ষা দেওয়া হত না। এইটাই ছিল মাওলানার বড় দুঃখ। তার প্রত্যয় ছিল মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষায় মিশনারীতে উন্নতি করতে হলে সাধারণ বিষয়ে বিশেষতঃ ভূগোল বিষয়ে জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। ফলশ্রুতিতে এছলামাবাদী রংপুরের কমেদপুর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হলে তিনি সেখানকার ছাত্রদের ইতিহাস ও ভূগোল বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দ্যোগী হন। তিনি নিজেই এই সময় “তছবিরে বাংলা” নামক উর্দু ভাষায় একটি ভূগোল বই রচনা করেন। মূলত এটি ছিল তার প্রথম লিখিত গ্রন্থ’।
অবশ্যই মাওলানার জীবনী লেখকগণ “তুরস্কের সুলতান” (১৯০১) পুস্তকটিই প্রথম প্রকাশ বলে মত দেন। মূলতঃ ১৯০১ থেকে ১৯২০ সাল এ দু’দশকে মাওলানার সৃষ্টিশীল কর্মযোগ ঘটে। এসময়ে তিনি অজস্র লিখেছেন এবং বহু পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। মুঘল শেষ স¤্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যনীতি নিয়ে যখন ঐতিহাসিকদের মধ্যে চরম মতদ্বৈততা বিরাজ করছে তখন মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী আওরঙ্গজেব নাম ইতিহাস গ্রন্থ লিখে হিন্দু মুসলমানদের সম্পর্ক উন্নয়নে আওরঙ্গজেবের ভূমিকা নির্ণয় করেন অকাট্য যুক্তি প্রমাণ দিয়ে। ১৮৯৭ সাল থেকে মাওলানা সাংবাদিকতা চর্চা শুরু করেন লাহোর থেকে প্রকাশিত “পয়সা আখবার ও অমৃত ঘর থেকে প্রকাশিত উকীল পত্রিকায় সংবাদাদী লেখনীর মাধ্যমে। এ সময় ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় ‘মছলা তলব’ শীর্ষক ধর্ম সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর প্রদানের মাধ্যমে মাওলানার সাংবাদিকতার পরিপূর্ণ প্রবেশ ঘটে। এ সময়ে মাওলানা এছলামাবাদীর তাঁর সৃজনশীল বিভিন্ন সাহিত্য ও বই রচনায় নিজে মনোনিবেশ করেন। এক তথ্যে দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ৮৩টি গ্রন্থ ও বিভিন্ন সাময়িকীতে দুই শতাধিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
(মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী রচনাবলী, (ঢাকা: বাংলা একাডেমি-১৯৯৩) পৃ. ১০২, ১০৩, ১০৪)।
তবে ১৯২০ সালের শুরু দিকে তাঁর লিখনীতে স্পষ্টত রাজনৈতিক দর্শন প্রতিফলিত হয়। খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে তিনি অজ¯্র প্রবন্ধ লিখেন। ড. মোহাম্মদ শহীদুললাহ্ বলেন মাওলানা সাহেব যুক্তিনিষ্ঠ ও স্পষ্ঠভাষী ছিলেন। ইসলামের আদর্শ প্রচার ও মর্যাদা বৃদ্ধি তাঁর জীবনের ব্রত ছিল সত্য, কিন্তু তিনি কখনও ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেননি।
রাজনীতি, সমাজ সংস্কার, শিক্ষা ও আর্থ-মানবতার সেবায় মাওলানা:
কর্মজীবনের শুরু থেকেই এছলামাবাদী মুসলিম সমাজের শিক্ষা ও উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন এবং কর্মপন্থা নির্ধারণ করতেন। এক্ষেত্রে মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতন করে তোলার প্রয়োজনীয়তাও তিনি উপলব্ধি করতেন। ফলশ্রæতিতে আমরা দেখতে পাই ১৯০৩ খ্রি. এর পর থেকে মাওলানা এছলামাবাদী যাবতীয় লিখনী রচনা, শিক্ষা আন্দোলন ও সামাজিক সংস্কার মূলক কার্যকলাপে চ‚ড়ান্ত প্রতিফলন ঘটে ১৯২০ সালের পরবর্তী খেলাফত, অসহযোগ আন্দোলনসহ কংগ্রেস, সমিয়তে উলমায়ে হিন্দু ও মুসলিম লীগের সাথে সরাসরি রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করা মধ্যে। উল্লেখ্য যে, মাওলানা কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের জন্য এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য কৃষক প্রজা আন্দোলনও গড়ে তুলেছিলেন। তবে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের চ‚ড়ান্ত প্রকাশ ঘটে জীবনের শেষ সময়ে ১৯৪৪-১৯৪৬ খ্রি.; ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেতা সুভাস বসু’র সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে। এসময় ব্রিটিশ সরকার কথিত ষড়যন্ত্রের অজুহাতে মাওলানা এছলামাবাদীকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করে এবং লাহোর সেন্ট্রাল কারাগারে প্রায় ১১ মাস অন্তরীন রাখে। এর পূর্বে “আগষ্ট বিপ্লবের” অভিযোগে মাওলানা এছলামাবাদীকে পূর্ববাংলা থেকে বাহিষ্কার করে এবং কিছুদিন অন্তরিন রাখে। মূলত জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ব্রিটিশ শোষণের হাত থেকে ভারত উপমহাদেশকে মুক্ত করা না গেলে এতাদঞ্চলে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা কোন রকমেই সম্ভব নয়।
উল্লেখ না করলে নয় যে, মাওলানা এছলামাবাদী ১৯১৩খ্রি. বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা ও নৈতিকতার উন্নয়নের জন্য ইসলাম মিশন, ইসলামের শিক্ষা সমিতি ও আনজুমানে ওলামা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দ্যোগ নেন এবং চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণে কর্ণফুলীর মোহনায় দেয়াং পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংকল্প ব্যক্ত করেন। এ সময় এই মৌজার জামিদার মাওলানা আনোয়ার আলী খাঁ ইসলামাবাদীর প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য দেয়াং পাহাড়ের প্রায় ২০০ বিঘা জমি প্রদান করেন। খিলাফত আন্দোলনের অন্যতম কর্ণধার মাওলানা শওকত আলী এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং একটি স্কুল ও একটি মাদ্রাসা প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু র্দুভাগ্য যে, এ বিপ্লবীর মৃত্যুর পর আর কোন ব্যক্তি বা সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেন নাই। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত জায়গায় নিলিপ্তভাবে বাণিজ্যিক শিল্প প্রতিষ্ঠান ইপিজেড প্রতিষ্ঠার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এছাড়া মাওলানা এছলামাবাদীর চট্টগ্রামের জামাল খান মৌজায় কদমমোবারক মসজিদ সংলগ্নে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা, সীতাকুন্ডে মসজিদ, মাদ্রাসা ও মুসলিম ছাত্রবাস প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের পড়ন্ত বিকালে অবসরকালীন সময়ে নিজ গ্রাম আড়ালিয়ায় পুত্রের নামে শামসুল ইসলাম সিনিয়র মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন পাঠাগার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। এসব প্রতিষ্ঠান মাওলানা ইসলামবাদীকে এখনও চির অমর করে রেখেছেন।
সর্বশেষ, আমার শিরোনামের সাথে প্রবন্ধের পূর্ণতা দেয়া সুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। মাওলানা এছলামাবাদী ৭৫ বছর বয়সের মধ্যে প্রাথমিক জীবনের ১২টি বছর বাদ দিলে বাকী ৬৩ বছরের প্রতি বছর, মাস, দিন ও ক্ষণে সংগ্রাম, সংস্কার ও সৃষ্টিশীল কর্মকাÐে ব্যয় করেছেন। অনুসন্ধানী গবেষকগণের মতে তাঁর জীবনের ৫০টি বছর শুধু মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কাটিয়েছেন। ড. আবদুল গফুর সিদ্দিকী অনুসন্ধান বিশারদ বলেন- ঐব ধিং ধ ভৎড়হঃ ষরহবৎ ঃযড়ৎঁময ড়ঁঃ ষড়হম ৫০ ুবধৎ ড়ভ পষড়ংব ঃড়ঁপয রিঃয ধষষ ঃযব ংড়পরধষ ধহফ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ঁঢ়ংঁৎমব রহ ইবহমধষ ধহফ ধষধিুং ধিং ড়ঢ়ঢ়ড়ংবফ ঃড় ফড়মসধ ধহফ ঝঁঢ়বৎরংঃরঃরড়হ. (মৌলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী রচনাবলী, বংলা একাডেমি, ১৯৯৩, পৃ.-৬৪)।
তিনি তাঁর সারাটি জীবন নিজ জাতি সম্প্রদায় ও ভারত উপমহাদেশের মুক্তিকামী মানুষের জন্য আর্তনাদ করেছেন। আজ মাওলানা এছলামাবাদী নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ,দর্শন ও কর্ম আমাদের উপলব্দীর বিষয়। তাঁর পৌন শতবছরের জীনাদর্শ পর্যালোচনা করলে পাওয়া যায়, একজন মানুষ মোমের মত নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলিন করে একটি সমাজ, একটি জাতি সর্বোপরি মানুষের মাঝে জাতীয়তাবোধ জাগরণের মাধ্যমে স্বাধীনতার ক্ষেত্র সৃষ্টি কওে গিয়েছেন- এটি তৎকালনি নয়; বাংলাদেমের সমকালীন প্রেক্ষিতে একটি আদর্শস্থানীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। এ বাংলার সাংগু নদীর প্রশাখা চানখালীর স্রোতপ্রবাহের ভাঙ্গা-গড়া দেখে যে মানুষটি বড় হয়েছেন; তিনিই সমাজের সকল সংস্কারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছেন জাতির মুক্তির জন্য একজন মাওলানা তার সেরা অবদানটি রাখতে পারেন। সমকালীন বাংলাদেশে যে মাওলানারা নানা মতে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে জিহŸার তীর ছুড়ছেন তাদের জন্য মাওলানা এছলামাবাদী এজন সেরা আদর্শ হতে পারে। মাওলানার পীর বা মুরশিদ না হয়েও তিনি মাইজভাÐার দরবারে গিয়ে বড় মাওলানার ঈঙ্গিত পেয়ে চাকুরিতে যান নি। সমকালীন বিপর্যস্ত আত্মাগুলোও এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারে যে, আধ্যাত্মীকতা মানুষের ভবিষ্যৎ কর্মসাধণের নির্দেশক। মাওলানার অর্থকড়ি, জমিদারী কিছু ছিল না, কিন্তু তাঁর অদম্য স্প্রীহা চট্টগ্রাম নগরীতে গড়ে তুলেছিলেন কদম মোবারক এতিমখানা। এরসাথে যুক্ত রয়েছে স্কুল, মাদ্রাসা, হেফজকানা। তিনি শুন্য দিগন্তে ইন্দ্রজালের মত অন্তঃদৃষ্টি দিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে উপলব্দী করতে পেরেছিলেন। আজ স্বাধীন সার্বভৌম এ বাংলাদেশে সব আছে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা, অনৈতিকতা, ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা, স্বার্থপরতা, রাজনীতির নামে শোষণ-বঞ্চনা ও বুর্জোয়া মনোভাব, সমাজপতির নামে অবক্ষয়জনিত চরিত্রে প্রদর্শন ও লালন এখন যখন নিত্য বিষয় তখন মালনা এছলামাবাদীর মত নিরহঙ্কার, নির্লোভ ও দেশপ্রেমিক একজন বিপ্লবীর বেশ প্রয়োজন অনুভব করছি। আমরা মাওলানা এছলামাবাদীর পরকালীন শান্তি ও সুউ”চ আসন (নিয়ামত) কামনা করি মহাপ্রভু আল্লাহর দরবারে।
(প্রবন্ধটি আজ ৯ অক্টোবর ২০১৯ইং মেট্রোপলিটন চেম্বার মিলনায়তনে চন্দনাইশ ছাত্র সমিতির সেমিনারে কী নোট হিসাবে উপস্থাপন করা হবে।)
লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ