মহাসড়কে মহাবিপদ

79

নতুন সড়ক আইন কার্যকরে নানা নাটকীয়তার মধ্যেই মহাসড়ক যেন মহাবিপদ রূপেই আবির্ভূত হয়েছে। নতুন বছরের একেবারে শুরুর দিন থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মিছিল চলছে। কারও দৌড়ঝাঁপই মহাসড়কে যাত্রী কিংবা পথচারীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। উল্টো আরও বেশি অনিরাপদ হওয়ার দিকেই হাটছে। চলতি মাসের গত ১৭ দিনেই দুই মহাসড়কে ১৭ জনেরও বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়–য়া বছরের শুরুতেই মহাসড়কে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর মিছিলে উদ্বেগ প্রকাশ করে পূর্বদেশকে বলেন, ‘নতুন সড়ক আইন পরিবহন খাতে বিরাজমান নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা নিয়ন্ত্রণে কতটা কাজে আসছে তার নমুনা আমরা একেবারে বছরের শুরুতেই দেখতে পাচ্ছি। আসলে সড়ক-মহাসড়ক ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে কোনোভাবেই তা নিরাপদ হয়ে উঠবে না। বরং দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে।’
হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তাসহ পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কে অবৈধ পার্কিং, ওভারটেকিংয়ের প্রতিযোগিতা, পথচারীদের অসতর্কভাবে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার, নির্ধারিত গতিসীমার চেয়েও অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো এবং চালকের অসতর্কতা মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মূল কারণ। অবশ্য বছরের শুরুতে রাতের বেলায় সংঘটিত কোনও কোনও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে শীতের কুয়াশারও দায় দেখছেন কেউ কেউ। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনেরও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
হাইওয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিটিগেট থেকে মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট পর্যন্ত অংশে অন্তত আটটি স্থানে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো হল, সীতাকুÐের ফৌজদারহাট বন্দর সংযোগ সড়ক, পিএইচপি গেট, জিপিএইচ কারখানা এলাকা, গুল আহমদ জুট মিল, মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাইপাস সড়ক, সোনাপাহাড় এলাকা, বিএসআরএম কারখানা এলাকা ও বারৈয়ারহাট বাজার। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া, লোহাগাড়া ও কক্সবাজারের রামু অংশে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়ায় দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে স্বামী-স্ত্রীসহ তিনজন নিহত এবং কমপক্ষে চারজন আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন, কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার কৈয়ারবিল এলাকার জাহিদ হোসেন (৩৮) ও তার স্ত্রী নিগার সুলতানা (৩২) এবং নগরীর ডবলমুরিং এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক (৩০)। নিহতরা সবাই লোকাল বাসের যাত্রী ছিলেন। আহত চারজনকে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দিকে ছেড়ে আসা শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে পটিয়াগামী একটি লোকাল বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এর দু’দিন আগে গত ১৫ জানুয়ারি সকালে একই মহাসড়কের পটিয়ার কমল মুন্সির হাটের সামনে রাস্তা পারাপারের সময় যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় অলি আহমদ সওদাগর (৭০) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। নিহত অলি আহমদ চন্দনাইশ উপজেলার উত্তর হাশিমপুর ইউনিয়নের সৈয়দাবাদ গ্রামের মৃত কবির আহমদের ছেলে। কমলমুন্সির হাটে রাস্তা পার হওয়ার সময় কক্সবাজারমুখী হানিফ সুপার পরিবহনের বাসটি ওই বৃদ্ধকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন।
নতুন বছরের শুরুতেই গত পয়লা জানুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে দশটার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা এলাকায় বাস ও প্রাইভেট কারের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিন যাত্রী নিহত হন। নিহতরা হলেন, নগরীর আতুরার ডিপো এলাকার বাসিন্দা জানে আলম (৩৫), হালিশহরের মাসুদ কিবরিয়া (৪০) ও পশ্চিম নাসিরাবাদের জামাল উদ্দিন (৩৫)। কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস বিপরীত দিক থেকে আসা একটি প্রাইভেটকারকে ধাক্কা দেয়। এতে প্রাইভেটকারটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই দু’জন নিহত হন। গুরুতর আহত দু’জনকে উদ্ধার করে প্রথমে রামু হাসপাতাল ও পরে কক্সবাজার হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক একজনকে মৃত ঘোষণা করেন। তারা সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী ছিলেন। একইদিন বেলা পৌনে এগারটার দিকে নগরীর পতেঙ্গা থানার সি বিচ সড়ক দিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলে নতুন বই আনতে যাচ্ছিল শিশু রেশমি আক্তার (১০)। সি বিচ সড়কের মুখে ট্রাকচাপায় নিহত হয় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রেশমি। দুর্ঘটনার পরে ট্রাকচালক আবদুল খালেক নিজেই মুমূর্ষু রেশমিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকেই পুলিশ তাকে আটক করে। গত ১১ জানুয়ারি দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া সদরের আলহাজ মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে সংঘটিত দুর্ঘটনায় উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের চেঁদিরপুনি বড়ুয়াপাড়ার স্বপন বড়ুয়ার ছেলে উত্তম বড়ুয়া (২০) ও একই এলাকার লিটন বড়ুয়ার ছেলে বিশাল বড়ুয়া (১৯) নিহত হন। পেশায় গ্যারেজ ও গ্রিল ওয়ার্কশপের কর্মী উত্তম ও বিশাল কাজশেষে রাত ১০টার দিকে প্রতিদিনের মত মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন। মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রæতগতির একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে তাদের মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে উত্তম ও বিশাল মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। মোটরসাইকেলটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
অপরদিকে, গত ৮ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সীতাকুÐের কুমিরা ও সলিমপুরে পৃথক দুটি দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে দুই শিশুসহ তিনজন। নিহতদের মধ্যে দু’জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তারা হলেন, মিরসরাইয়ের সমিতিরহাট গ্রামের বাসিন্দা মেজবাহ উদ্দিন (৩৫) ও একই উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল লতিফপুরের বাসিন্দা মো. আবদুল্লাহ (৩৩)। অপর দুর্ঘটনায় নিহত নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। রাত সাড়ে দশটার দিকে ফকিরহাট এলাকায় এক নারী তার পাঁচ বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে মহাসড়ক পার হওয়ার জন্য সড়ক বিভাজকের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় দুটি ট্রাক একে অপরকে ওভারটেক করতে গিয়ে ওই নারীকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ওই নারী মারা যান। তার আগে রাত আটটার দিকে কুমিরা ইউনিয়নের গুল আহম্মদ জুট মিলস এলাকায় আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাকামুখী একটি প্রাইভেটকার গুল আহম্মদ জুট মিলস এলাকায় পৌঁছালে একটি শিশু হঠাৎ করে গাড়িটির সামনে দিয়ে দৌড় দেয়। এ সময় শিশুটিকে রক্ষা করতে গিয়ে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টো দিকের লেনে গিয়ে পড়ে। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকের চাপায় গাড়িতে থাকা দুই যাত্রীসহ তিনজন আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে সীতাকুÐ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মেজবাহকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে আবদুল্লাহ নামে আরেকজন মারা যান। এ ঘটনায় গাড়ির চালক ও শিশু নাহিদ আহত হয়। এর তিনদিনের মাথায় গত ১১ জানুয়ারি ভোর পাঁচটার দিকে সীতাকুÐের ফৌজদারহাট বন্দর সংযোগ সড়কের মুখে সংঘটিত দুর্ঘটনায় পুলিশের এক সদস্যসহ মোটরসাইকেলের দুই আরোহী নিহত হয়েছেন। নিহত পুলিশ সদস্যের নাম মো. আলমগীর হোসেন (২৪)। আর অন্যজনের নাম শহিদুল ইসলাম (২৭)। দুজনের বাড়ি কুমিল্লায়। তারা দুজন পৃথক দুটি মোটরসাইকেলে ছিলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে বন্দর সংযোগ সড়কের দিকে ঘোরার সময় ঢাকামুখী একটি গাড়ি তাদের ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। একই জায়গায় ২৮ ডিসেম্বর সকালে লরির সঙ্গে প্রাইভেট কারের সংঘর্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সাইফুজ্জামান পিন্টু ও তার দুই মেয়ে আশরা আনাম খান (১৩) ও তাসমিন জামান খান (১১) নিহত হন। আহত হন তার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে। নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা পিন্টু পরিবার নিয়ে প্রাইভেটকারে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। তিনি নিজেই প্রাইভেটকারটি চালাচ্ছিলেন। আর বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শুধুমাত্র সিটি গেট থেকে বারেয়ারহাট পর্যন্ত অংশেই ৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪৬ জন। আহত হয়েছে তিনশ’ ৭১ জন।