‘মহান শিক্ষা দিবস’ যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাই কাম্য

49

আজ মহান শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণআন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত এই দিন। ইতিহাস থেকে জানা যায়- পাকিস্তানি সামরিক জান্তা শরিফ শিক্ষা কমিশন গঠন করে, পশ্চাদমুখী ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারার একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তোড়জোড় শুরু করলে তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্বে গঠিত ‘অল পার্টি স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি’ উদ্যোগে এর তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু করে। সর্বশেষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমনপীড়ন মাত্রাতিরক্ত রূপ নিলে সংগঠনটি দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচির ডাক দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা লেলিয়ে দেয় পুলিশ বাহিনী। তারই একপর্যায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট মোড়ে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহসহ অনেকে শহীদ হন। সেই থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ছাত্র সংগঠন প্রতি বছর এ দিনটিকে ‘মহান শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। প্রতিবছরের মতো এবারও মহান শিক্ষা দিবস উপলক্ষে এ দিবসের শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে তা সীমিত আকারে পালন করা হবে বলে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর অফিসিয়াল নোটিম সূত্রে জানা যায়। বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ আজ সকালে হাইকোর্টসংলগ্ন শিক্ষা অধিকার চত্বরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছে। প্রসঙ্গত, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শরীফ কমিশন নামে খ্যাত এসএম শরীফের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তা প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে গিয়েছিল। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। কর্মসূচিতে পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনীর নির্বিচারে গুলি ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে শুরিু হয় ব্যাপক কর্মসূচি, সৃষ্টি হয় একের পর এক ইতিহাস। ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের ছাত্রসমাবেশ থেকে শিক্ষানীতি বাতিল, হত্যার বিচারসহ ছাত্রসমাজের উত্থাপিত দাবি মানার জন্য চরমপত্র ঘোষণা করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্থগিত করে। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে ৬৬’র ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় গভীর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সেদিন ছাত্রসমাজই পালন করেছিল নতুন ইতিহাস নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা, যার ধারাবাহিকতা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে। এ শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের যে বিস্ফোরণ তাতে ’৬৯-এর গণঅভ‚্যত্থান পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হলেও স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও এদেশের মানুষ একটি কাক্সিক্ষত শিক্ষানীতি পায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গীকার ছিল গণমুখী, সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, অসা¤প্রদায়িক, বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এদেশের ছাত্রসমাজকে এখনও শিক্ষার অধিকার আদায়ে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ’৭৫-র পরবর্তী প্রতিটি সরকার ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ এই নীতির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পালন করে গেছে অগ্রণী ভূমিকা।
সর্বশেষ বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর প্রণিত শিক্ষানীতিকে সংযোজন, পরিমার্জন ও আধুনিকায়ন করে পূর্ণাঙ্গ একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলেও ছাত্রসমাজ তথা জনগণের আকাক্সক্ষার পরিপূর্ণ প্রতিফলন তাতে ঘটেনি। এরপরও মন্দের ভালো হিসাবে দেশের মানুষ তা গ্রহণ করেছে, কিন্তু গত ১০ বছরেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। যেকোনো নীতি প্রণয়নে ও তা বাস্তবায়নে প্রতিফলন থাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তথা সরকারের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের। বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের স্বাধীনতার পক্ষের সরকার বিদায় সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সার্বজনীন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের বাধ্যবাধকতাকে তারা যথাযথ কাজে লাগাতে পারত, কিন্তু অদৃশ্যকারণে তা উপেক্ষিত হচ্ছে। এরপরও বর্তমান সরকার গত একদশকে শিক্ষার সংকটগুলো চিহ্নিত করে আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী একটি বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে-এমন প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।