মহান মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ দিবসের সার্থকতা

78

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম

১লা মে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন সংগ্রামের মাইলফলক। নতুন নতুন দাবি আদায়ের সংগ্রামী চেতনার দিন। প্রথম মহাযুদ্ধে (১৯১৪-১৯) ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে যুদ্ধের বোঝা শ্রমিকদের উপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া সভ্যতা ও ধ্বংসকারী বিপর্যয় এড়াতে বিশ্বব্যাপী নেতৃবৃন্দ ঐক্যের নামে একটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেন। ঐ সময় শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই.এল.ও) প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত এই সকল সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করা। ১৮০৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে কারখানায় ২০ ঘণ্টা কাজ করতে হবে-এটাই ছিল শ্রমিকদের জন্য মালিক পক্ষের বেঁধে দেয়া নিয়ম। শুরু হলো শ্রমিক অসন্তোষ এবং মালিক পক্ষের বাড়াবাড়িও পৌঁছলো চরমে। ১৮৮১ সালে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হলো জাতীয় শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। সকল শ্রেণীর শ্রমিক এতে যোগ দিল। এর আগে ১৮৬৪ সালে লন্ডন ইউরোপে শ্রমিক সংগঠনের নেতা, সামাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ,দার্শনিক,বিভিন্ন পেশাজীবী,বুদ্ধিজীবী শ্রমজীবীদের নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। দীর্ঘ ২২ বছর পর ১৮৮৬ সালে ৮ ঘণ্টার অধিক কাজ না করার ঘোষণা দিল শ্রমিক পক্ষ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মালিক পক্ষের নির্দেশে ম্যাককর্মিক হারভেস্টারে নিরীহি শ্রমিকদের উপর গুলি চালালো পুলিশ, প্রাণ হারালো ৬ জন শ্রমিক। ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা সম্মেলন। ১৯২০ সালে ভারতের বন্দর নগরীতে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে দেশ বিভক্ত হওয়ার পর পাকিস্তান বা ভারতে শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য শক্তিশালী কোনো সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু প্রথম নিজস্ব উদ্যোগে বন্ধ হওয়া কিছু কলকারখানা, জুট মিল, চা-শিল্পগুলোকে চালু করার মধ্য দিয়ে শ্রমিক,কৃষক, মেহনতি জন সাধারণকে দ্রæত উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত করে দেশকে শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণী যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে সে ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন।
‘৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর পরবর্তী সরকারগুলোর ছত্রছায়ায় জাতীয় সম্পদ লুট করে এর বিপরীতে একদল লুটেরা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। আর একের পর এক মিল কারখানা পরিকল্পিতভাবে রুগ্ন শিল্পে পরিণত করে চলল। শ্রমিক কৃষক সাধারণ মেহনতি মানুষ আবারো বঞ্চিত হতে লাগলো তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আবারো ভূলুন্ঠিত হলো। ২০০৬ সালে দেশে নতুন শ্রম আইন করে শ্রমিকের অধিকার খর্ব করা হলো। যেটুকু অধিকার শুধু কাগজে কলমে-বাস্তবে তা রূপ পায় না। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে দমন পীড়নসহ শ্রমিদের চাকুরিচ্যুত, ছাঁটাই, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি যেন নিত্যনৈতিমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি মালিক পক্ষের নূন্যতম সহানুভূতিও নেই। রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী যে ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের দাবি নিশ্চিত করেছিলো তাও আজ কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ১০৬ বছর পর আবারো প্রথম মহাযুদ্ধের বিপর্যয়ের মত অপর একটি বৈশ্বিক মহামারী বিপর্যয় করোনা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বন্ধ করা হয়েছে।
শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে আবারো আন্দোলন সংগ্রামে নেমেছে। অথচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মানবতার মা জননেত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কথা চিন্তা করে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এতে বলা হয়েছে যারা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করবে তারাই এই তহবিলের অর্থ পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবে। মাত্র ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হবে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে। এতেকরে শিল্প-কারখানার মালিকরা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিবে। অন্য দিকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক তাদের বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই।
হাদিস শরীফে আছে-রাসূল (সা.) বলেন,’তোমরা শ্রমিককে শরীরের ঘাম শুকানোর আগে তার পাওনা মিটিয়ে দাও।’ এই মহা বিপর্যয় ও দুর্যোগের দিনে এতটুকু সহানুভূতি শ্রমিকদের জন্য মালিক পক্ষের নেই। এর চেয়ে দুঃখ ও লজ্জাজনক ঘটনা জাতির জন্য আর হতে পারে না। এই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার কোন বিকল্প নেই। তাই শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা আন্দোলন সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলে শ্রম দিবস বা মহান মে দিবস সফল ও সার্থক হবে।

লেখক : শ্রম সম্পাদক
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ