মহররম মাস ও শাহাদাতে কারবালা

61

হিজরী সনের প্রথম মাস ‘মহররম’ মহররম অর্থ ‘ অবৈধ ঘোষিত’। এ মাসে সকল ধরনের যুদ্ধ সংঘাত অবৈধ বলে মাসটির নাম মহররম রাখা হয়েছে। মাসটি মর্যাদাবান বলে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক হাদিসে ঘোষণা করেছেন। পুরো মাসের দশ তারিখ বসচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ এবং মর্যাদাবান। এ দিনটিকে বলা হয় আশুরার দিন।
ইতিহাসে মাসটি ঘটনাবহুল হিসাবে খ্যাত। আমিরুল মোমেনিন খলিফাতুল মোসলেমিন হযরত ওমর ফারুক (রা.) আল্লাহর রাসুল (দ.)’র নিকট জানতে চাইলেন, হে রাসুলুল্লাহ! আল্লাহ আশুরার রোজায় ব্যাপক ফজিলত প্রদান করেছেন। নবীজী ইরশাদ করলেন, হ্যা। কারণ এইদিন মহান আল্লাহ পাক আরশ কুরসী, চন্দ্র তাঁরা আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন। হযরত জিব্রাইল (আ.)সহ অন্যান্য ফেরেস্তাদের এই দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। এইদিনে হযরত ইব্রাহিম (আ.), আদম (আ.)কে সৃষ্টি করা হয়েছে। আশুরার দিন হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে নমরূদের অগ্নিকুÐ হতে মুক্তি দিয়েছেন। ফেরাউনকে এইদিনে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে। হযরত ইসা (আ.) দুনিয়াতে শুভ আগমন করেছেন এই দিনে। আশুরার দিন হযরত ইদ্রিস (আ.)কে আসমানে তুলে নেন। এইদিনে হযরত আদম (আ.)’র তাওরা কবুল এবং দাউদ (আ.) তাজপ্রাপ্ত দ্বারা সম্মানিত হন। হযরত সোলাইমান (আ.) আশুরার দিন মানব ও জ্বীন জাতির ওপর ক্ষমতা লাভ করেন। মহান আল্লাহ পাক জাল্লে শানহু এই দিন আয়শের উপর আলোকময় হন। আসমান হতে পৃথিবীতে এইদিনে বৃষ্টি বর্ষণ হয়। কেয়ামত এইদিন সংঘটিত হবে। (সূত্র ঃ মাহবুবে মোবহানী গাউসে পাক আবদুল কাদের জিলানী (রা.) রচিত ‘রচিত গুনয়াতুত্ তালেবীন;দ্রঃ)
আনিসুল ওয়ায়েজীন গ্রন্থে বর্ণিত আছে, খলিফাতুল মোসলেমিন হযরত ওসমান (রা.) রেওয়াত হয়েছে, রাসুল (দ.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাকের মাস ‘মহররমকে গুরুত্ব দাও। যে ব্যক্তি মহররম মাসকে মর্যাদা প্রদান করবে আল্লাহ পাক তাঁকে বেহেস্তে মর্যাদা প্রদান করবে এবং দোজখের অগ্নি হতে রক্ষা করবে।
উম্মুল মোমেনি হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার দিনই রোজা রাখা হতো। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর প্রিয় নবী (দ.) ইরশাদ করেছেন, এখন তোমরা চাইলে আশুরার রোজা রাখতে পার চাইলে না রাখতে পার’। (বোখারী শরীফ)
বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) যখন মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করেন তখন মদিনায় এক ইহুদীকে রোজা পালন করতে দেখলে তার কাছে জানতে চাইলেন, তুকি কিসের রোজা রেখেছো ? সে বললো আজ আশুরার দিন। এই দিনে হযরত মুসা (আ.) ও বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রæর কবল হতে রক্ষা করা হয়েছিল। তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আমি রোজা রেখেছি। তাদের কথা শুনে নবীজী বললেন, আমরা মুসা (আ.)কে তোমাদের চেয়ে বেশি সম্মান করি। এ কথা বলার পর মহানবী (দ.) নিজেও রোজা রাখলেন এবং মুসলমানদেরকে রোজা রাখার আদেশ প্রদান করলেন, (সহীহ বোখারী)
মহররম মাসে কারবালার প্রান্তরে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাÐ সংঘটিত হয়। এই ঘটনা প্রকৃত মুসলমানদের হৃদয়ে রেখাপাত করে। সত্য মিথ্যার দ্ব›দ্ব পৃথিবীতে চিরকাল থাকবে। ইমাম হোসাইন (রা.) সত্য প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন বলে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন।
কারবালার শিক্ষা হলো সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায় কিন্তু পৃথিবীর কোন কিছুর বিনিময়ে সত্যকে ত্যাগ করা যায়। এই শিক্ষা মুসলমানদের নিকট রেখে যাওয়ার জন্য তিনি শহীদ হয়েছেন কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি।
খোলাফায়ে রাশেদীনের তিনজন নামধারী মুসলমানদের হাতে শহীদ হয়েছেন। ইমাম হোসেন কোন অমুসলিমদের হাতে শহীদ হননি। তিনিও নামধারী ইজীদী মুসলমানদের হাতে শহীদ হয়েছেন। পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন দুই ধররের মুসলমান থাকবে। হোসাইনী মুসলমান আর ইজীদী মুসলমান। যারা ইমাম হোসাইন (রা.)কে শহীদ করে ছিলেন তারা বলেছিলেন, তাড়াতাড়ি হত্যাকর, আসরের নামাজ কাজা হয়ে যাচ্ছে। হযরত নামাজী। নামাজে গিয়ে বলবে, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মোহাম্মদ ওয়াল আলে মোহাম্মদ’ অর্থাৎ মোহাম্মদ এবং তাঁর পরিবারকে রহম কর। এরা ইয়াজিদী নামাজী। যাদের হৃদয়ে কোন আহলে বাইতের প্রেম নেই।
দশ মহররম দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য এক মহা ট্রাজেডির দিন। এই দিন হতে চিরদিন মুসলমানগণ সত্য প্রতিষ্ঠার প্রেরণা পাবে। ইয়াজিদ বাহিনী যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, ইমাম হোসেন (রা.) ত্যাগের কারণে মুসলমানদের হৃদয়ে অবস্থান নিয়েছেন। বেঁচে থাকবেন মহাপ্রলয়ের শেষ রজনী পর্যন্ত। এজিদ আড়াই বছরের নিন্দিত শাসকের নাম। এজিদের পাপাচারের কথা স্মরণ ছিল বলে যে তার আপনজনদের মৃত্যুর পূর্বে বলে গিয়েছিল, মৃত্যুর পর কেউ যেন তার কবরে খদিস না পায়। ইয়াজিদ জানতো জীবিত থাকতে নয় মৃত্যুর পরও বিশ্ববাসী তাকে চরম ঘৃণা করবে। তার কবরে জুতো নিক্ষেপ করবে। আজ পর্যন্ত বিশ্ববাসী জানে না এজিদের কবর কোথায় ! অথচ ঈমাম হোসাইন (রা.)কে বিশ্ববাসী শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং তাঁর জন্য অশ্রæ বিসর্জন দেয়। ইমাম হোসেন (রা.)’র আত্মত্যাগ আমাদেরকে শিক্ষা দেয় ইসলাম রাজতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল কোন ধর্ম নয় ইসলাম সহনশীল গণতান্ত্রিক ধর্ম।
ইজিদ যে ধরনের জঘন্য কাজ করেছে সে ধরনের কাজ কোন অমুসলিম কাফিরগণও করেনি। তিন বছরের কম সময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে জঘন্য তিনটি কাজ করে। প্রথম বছর পবিত্র মদিনা শরীফ দখল করে হাজার হাজার সাহাবী শহীদ করে। মসজিদে নববীতে নামাজ বন্ধ কয়ে ঘোড়ার আস্তাবল করে। দ্বিতীয় বছর মক্কা শরীফে হামলা করে খানায়ে ক্বাবা ধ্বংস করে এবং কাবার গিলাফে আগুন ধরিয়ে দেয়। তৃতীয় বছর আওলাদে রাসুল, আহলে বাইতে রাসুল (দ.) ইমাম হোসেনকে শাহাদাত করে।
ইমাম হোসেনের (রা.) শাহাদাত মুসলমানদেরকে দুঃখের কঠিন পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করে মহান আল্লাহ পাকের উপর বিশ্বাস রাখার শিক্ষা দেয়। কারবালার শাহাদাতে শুধু ইমাম হোসাইন শহীদ হননি আওলাদে রাসুল(দ.)’র ৭৩ জনের মধ্যে ৭২জন শহীদ হন। ইমাম হোসেনের শরীর সোবারকে ৭৩টি জখম হলেও তিনি তথ্য ও ন্যায়ের পথ হতে বিচ্যুত হননি। শাহাদাতের পর তাঁর দেহ মোবারককে ঘোড়া দ্বারা পদদলিত করা হয়েছিল। আজও আমাদেরকে ইমাম হোসেন (রা.)’র জীবন থেকে আমাদেরকে শিক্ষা অর্জণ করতে হবে। না হলে মুসলমানদের মুক্তি আসবে না। কারবালায় যেমন মুসলমান নামধারী মোনাফেক ছিল আজও মুসলমান নামধারী মোনাফেক আছে যারা ইসলামকে কলঙ্কিক করছে। ইহুদীদের দালাল হিসাবে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদী কার্যক্রম লিপ্ত হয়ে ইসলামের ক্ষতি করছে। মুসলমানদের চিন্তা করতে হবে। অন্যান্য দেশগুলো শান্তিতে থাকলেও মুসলিম দেশগুলোতে কেন অশান্তি। একথার মর্মার্থ না বুঝলে মুসলমানদের মুক্তি আসবে না।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক