মহররমের ফজিলত ও গুরুত্ব

89

হিজরী সনের প্রথম মাস মহররম। বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর কাছে এই মাস নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ১০ মহররম পবিত্র আশুরা। ইসলামের ইতিহাসে শোকাবহ একটি দিন। হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেইন (রা.) ও তাঁর পরিবার এবং অনুসারীরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শহীদ হন। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে হযরত ইমাম হোসেইন (রা.) ও অন্যদের আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জল রয়েছে। কারাবালার শোকাবহ এই ঘটনা অর্থাৎ পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী সকলকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে প্রেরণা যোগায়।
কারাবালার ঘটনা : ইয়াজিদ ইসলামী শাসনব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটানোয় হুসাইনের (রা.) পক্ষে সেটা মেনে নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনই ছিল ইমাম হুসাইনের (রা.) সংগ্রামের মূল্য লক্ষ্য। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থনও ছিল তার পক্ষে। উপরন্তু কুফাবাসী ইয়াজিদের অপশাসনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বারবার ইমাম হোসাইনের সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকলে তিনি তাতে সাড়া দেন। তিনি কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কুফার অবস্থা জানার জন্যে হোসাইন (রা.) তার চাচাতো ভাই মুসলিম-বিন-আকিলকে সেখানে পাঠান। আকিল কুফাবাসীর সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে ইমাম হোসাইনকে কুফায় আসতে অনুরোধ করে পত্র লিখেন। কিন্তু এর মধ্যে ইয়াজিদের অধীনস্থ ইরাকের শাসনকর্তা কঠিন হৃদয়ের ওবায়দুল্লাহ বিন জায়াদ আকিলকে খুঁজে বরে করে তাকে হত্যা করে এবং তাকে সহায়তাকারীদেরও খুঁজে হত্যা করে। এতে কুফাবাসীরা ভীত হয়ে পড়েন। তারা হোসাইন (রা.) এর সাহায্যে এগিয়ে আসতে আর সাহস পেল না। কুফাবাসীরা ইমাম হোসাইন (রা.) কে খলিফা হিসেবে দেখতে চাইলেও ইমাম হোসাইন (রা.) এর জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে রাজি ছিল না। ইয়াজিদের নির্মমতা কথা জেনেও ইমাম হোসাইন (রা.) এর সঙ্গীরা যে জেনেশুনে বুঝেই ইমামের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তা খুবই স্পষ্ট। ইমাম (রা.)-কে ভালোবেসে, তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখেই তারা ইমামের (রা.) সাথে থেকে প্রাণপণে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার সঙ্গীদের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে, তরবারির সেই আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে আরো বেশি কষ্টকর ছিল জনগণের অজ্ঞতা এবং মুর্খতার আঘাত। সেজন্যই জনতার অজ্ঞতাপ্রসূত ভাবনার পর্দা অপসারণ করাই ছিল তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আকিলের পাঠানো পত্র পেয়ে ইমাম হোসাইন স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়স্বজন, সহযোগীসহ কুফার পথে রওনা হন। কুফার ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর হোসাইন (রা) কে ইয়াজিদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণের নির্দেশ দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তারা ফোরাত নদীর তীর ঘিরে দÐায়মান হলো এবং হোসাইন (রা.) শিবিরের পানি সরবরাহ পথ বন্ধ করে দিলো।
আশুরার দিনে কারাবালার পরিস্থিতি দ্রæত অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ইমামের (রা.) সঙ্গীরা ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা.) কে অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়ায় ইমামের (রা.) ছোট্ট শিশু সন্তানেরা প্রচÐ তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে হযরত আব্বাস (রা.) ফোরাতে যান পানি আনতে। নিজেও তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন। আজলা ভরে পানি তুলে খেতে যাবেন এমন সময় তার মনে পড়ে যায় ইমাম হোসাইন (রা.) এর তৃষ্ণার্ত শিশু সন্তানের কথা। পানি ফেলে দিয়ে মশক ভর্তি করে তাবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই শত্রæর তীরের আঘাতে তার এক হাত কেটে যায়। মশকটাকে তিনি অপর হাতে নিয়ে ইমানের (রা.) তাবুর দিকে ছুটলেন। এবার অপর হাতটিও কাটা পড়ে। মশকটাকে এবার তিনি মুখে নিয়ে তাবুর দিকে যেতে চাইলেন। শত্রæর তীর এবার সরাসরি তার দেহে আঘাত হানে। এভাবে তিনি শহীদ হয়ে যান। এরপর অসম এ যুদ্ধে একে একে ৭২ জন শহীদ হন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দুরাবস্থায় পতিত হয়ে হোসাইন (রা.) ওবায়দুল্লাহ’র কাছে তিনটি প্রস্তাবের যেকোনো একটি গ্রহণের অনুরোধ জানান। তা হলো হয় তাকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক, কিংবা তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক, না হয় ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্য দামেস্কে যেতে দেয়া হোক। কিন্তু পাষাণ ওবায়দুল্লাহ এর কোনোটাই মানলো না। এ দিকে ১০ দিন অবরুদ্ধ থাকার কারণে পানির অভাবে হোসাইন (রা.) এর শিবিরে হাহাকার পড়ে গেল। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালার প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধ শুরু হলো। হোসাইনের (রা.) ভ্রাতুস্পুত্র কাশিম শত্রæর আঘাতে শাহাদত বরণ করলেন। তৃষ্ণার্ত হোসাইন (রা.) এর শিশুপুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন; কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর শিশুপুত্রের শরীরে বিদ্ধ হয়ে শিশুপুত্রটি শাহাদতবরণ করলে একাকী অবসন্ন হোসাইন (রা.) তাঁবুর সামনে বসে পড়লেন। সীমার নামে ইয়াজিদের এক সৈন্য তরবারির আঘাতে হোসাইন (রা.)-কে নামাজরত অবস্থায় মস্তক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো। এক পযায়ে হোসাইন (রা.) পরিবারের জীবিত সদস্যদের বন্দী করে দামেস্কে ইয়াজিদের কাছে পাঠানো হয়। এ দিকে হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের ঘটনা দেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলল। ইয়াজিদ ভয় পেয়ে গেল। জনরোষের বয়ে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে সে বন্দীদের মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দিলো। সেখানেই কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার শেষ হয়। ত্যাগের মহিমায় সমুন্নত কারবালার শিক্ষা ন্যায়ের পথে পথিকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।
১০ বহররমের ৩ আমল
রোজা রাখা : আশুরার দিনে আমল হিসেবে তিনটি কাজ করা যায়। প্রথমত, রোজা রাখা। এ আমল সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আশুরা উপলক্ষে দুই দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। মহররমের ১০ তারিখে আগে বা পরে এক দিন বাড়িয়ে রোজা রাখার কথা হাদিস শরিফে এসেছে। ইসলামে আশুরার রোজার বিশেষ গুরুত্ব আছে। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) আমাদের (রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে) আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। আর এ বিষয়ে তিনি নিয়মিত আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না, নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না। (মুসলিম, হাসিদ: ১২২৮) ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে রাসুল (সা.) কে সেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতে দেখিনি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০০৬, মুসলিম, হাদিস : ১১৩২)
পরিবারের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করা : আরেকটি আমল বর্ণনা সূত্রে দুর্বল হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আর তা হলো, আশুরার দিনে যথাসাধ্য খাবারের প্রশস্ততা প্রদর্শনা করা। যথাসম্ভব ভালো খাবার খাওয়া। হযরত আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারের প্রশস্ততা প্রদর্শন করবে, সে সারা বছর প্রশস্ততায় থাকবে। (তাবারানি, মুজামে কবির, হাদি : ১০০০৭ : বায়হাকি, হাদিস : ৩৭৯৫) এ হাদিসের বর্ণনা সূত্রে দুর্বলতা আছে। তবে ইবনে হিব্বানের মতে, এটি ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের হাদিস। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর দাবি, রিজিকে প্রশস্ততার ব্যাপারে কোনো হাদিস নেই। এটি ধারণাপ্রসূত। ইমাম আহমদ (রহ.) বলেছেন, এটি বিশুদ্ধ হাদিস নয়। তবে এ বিষয়ে একাধিক বর্ণনা থাকার কারণে ‘হাসান’ হওয়া অস্বীকার করা যাবে না। আর হাসান লিগাইরিহি’ পর্যায়ের হাদিস দ্বারা আমল করা যায়। (আস-সওয়াইকুল মুহরিকা আলা আহলির রফজি ওয়াদ দালাল ওয়াজ জানদিকা : ২/৫৩৬)
নবীর পরিবারের জন্য দোয়া পাঠ করা : আরেকটি আমল যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত। আর তা হলো, আহলে বাইত তথা নদীর পরিবারের সদস্যরা শাহাদাতের কারণে তাঁদের জন্য দোয়া করা, দরুদ পড়া এবং তাঁদের কাছে সত্যের ওপর অটল থাকার শিক্ষা গ্রহণ করা। এই তিনটি কাজ ছাড়া আশুরায় অন্য কোন আমল নেই।
স্মরণ রাখতে হবে, ইসলামের ইতিহাসে মহররম মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিভিন্ন কারণে। প্রাক-ইসলামী যুগেও মহররমের ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য কালজয়ী ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী পুণ্যময় এ মাস। আর কারবালার ঐতিহাসিক ট্রাজেডিও আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। রচিত হয়েছে শোকাভিভূত এক নতুন অধ্যায়। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনাই আশুরার একমাত্র ও আসল প্রেরণার উৎস নয়। আশুরার ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, জাহেলি যুগে মক্কার কুরাইশ বংশের লোকেরা আশুরার রোজা রাখত এবং রাসূল (সা.) ও আশুরার রোজা রাখতেন (সহিহ মুসলিম : ২৬৩২)
বিশ্বের মুসলমানেরা আশুরার এই দিনে মহানবী (সা.) এর পরিবার তথা আহলে বাইতের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা প্রদর্শনের সাথে সাথে জীবনের তাবৎ কর্মকাÐে ইমাম হোসাইনের আদর্শকে লালন করতে পারলে সকল অন্যায় ও অবিচার দুরীভূত হয়ে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক