মরিয়া আ.লীগ, নীরব ভোট বিপ্লবের আশায় বিএনপি

57

নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুয়ায়ী শুক্রবার সকাল থেকে সকল ধরনের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেলেও রবিবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দিনদিন নির্বাচনী উত্তাপ ছড়াচ্ছে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) সংসদীয় আসনে। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচারণা বন্ধ হওয়ার আগমুহুর্ত পর্যন্ত মহাজোট মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাফর আলম পুরো সংসদীয় আসনের অলিগলি চষে বেড়ালেও বাধার মুখে তেমন দৃশ্যমান প্রচারণায় দেখা যায়নি বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী সাবেক সাংসদ এডভোকেট হাসিনা আহমেদকে।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সাল থেকে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে হাতছাড়া হওয়া এ আসনটিতে নৌকার বিজয় ছিনিয়ে আনতে দলীয় নেতাকর্মীরা সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এখন একাট্টা হয়ে কাজ করছেন। মহাজোট প্রার্থী জাফর আলম পৌর মেয়র এবং উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালীন চকরিয়া পেকুয়ায় ব্যাপক উন্নয়ন করেন। দীর্ঘ সময় ধরে চকরিয়া পেকুয়ার মানুষের কাছে থেকে তাদের সেবা এবং সুখ-দুখের সাথী হওয়ায় এলাকার মানুষের কাছে মহাজোট প্রার্থী জাফর আলম অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক উন্নয়নের কথা স্মরণ করে এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে চকরিয়া-পেকুয়ার জনগণ এবার নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে জাফর আলমকেই বিজয়ী করবেন বলে প্রত্যাশা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের।
অপরদিকে বিএনপি নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত স্বাধীনতা পরবর্তী এ আসনটিতে ৫ বার বিজয়ী হয় বিএনপি। বিএনপির বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তিনবার এবং তার সহধর্মীনি এডভোকেট হাসিনা আহমেদ একবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমান একাদশ সংসদ নির্বাচনে বাধার মুখে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী দৃশ্যমান প্রচারণা চালাতে না পারলেও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমেদ এর ব্যাপক জনপ্রিয়তায় এবং অতীতে তার ব্যাপক উন্নয়ন যজ্ঞের কথা স্বীকার করে চকরিয়া পেকুয়ার ভোটাররা ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে রায় দেবেন। ভোটারদের নীবর ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে আবারও এ আসনটি পুনরুদ্ধারের আশা করছে বিএনপি। তবে নির্বাচনের সুষ্টু পরিবেশ সৃষ্টি, শাসক দলের নেতাকর্মীদের দলীয় প্রভাব এবং বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলায় গ্রেপ্তার ইস্যু নিয়ে আতংক ছাড়ছে না বিএনপিসহ জোটের নেতাকর্মীদের।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে আটজন প্রার্থী তাদের মনোনয়ন ফরম জমা দেন। তারা হলেন মহাজোট মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক উপজেলার চেয়ারম্যান জাফর আলম এবং মহাজোটের শরীকদল জাতীয় পার্টির বর্তমান সাংসদ মো. ইলিয়াছ, মহাজোটের অন্যতম শরীকদল ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ও কক্সবাজার জেলা সভাপতি আবু মো. বশিরুল আলম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএ) এর ফয়সাল চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মৌলানা আলী আজগর এবং দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জাফর আলমের মেয়ে তানিয়া আফরিন জাফর ও বিএমচর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা বদিউল আলম। জাতীয় পার্টির বর্তমান সাংসদ মো. ইলিয়াছ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করলেও শেষ সময়ে এসে মহাজোট প্রার্থী জাফর আলমের পক্ষে কাজ করছেন তিনি। তবে বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত প্রচার প্রচারণা চালিয়েছেন মহাজোটের অন্যতম শরীকদল ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ও কক্সবাজার জেলা সভাপতি আবু মো. বশিরুল আলম। এছাড়া মাঝে মধ্যে নির্বাচনী পচারণায় দেখা মিলেছে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএ) এর ফয়সাল চৌধুরী ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মৌলানা আলী আজগরকে। অন্যান্য প্রার্থীদের প্রচারণা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চোখে পড়েনি।
চকরিয়া ও পেকুয়া দুই উপজেলা নিয়ে কক্সবাজার-১ সংসদীয় আসনটি গঠিত। এ আসনের হালনাগাদ ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬৭৫ জন। তৎমধ্যে পুরুষ ভোটার রয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ৪৩৫ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৮৬ হাজার ২৪০জন। মুলতঃ এ আসনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নির্ভর করে চকরিয়া উপজেলার ভোটারের ওপরই। জেলার চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে এ আসনটি বিএনপির দুর্গ হিসাবেই পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালে একবার এ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বিজয়ী হলেও দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে আর জয়ের মুখ দেখেনি আওয়ামী লীগ। দেশে অনুষ্ঠিত হওয়া ১০টি সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) তিনবার, জামায়াত একবার ও বিএনপি প্রার্থী পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে ৩৭ হাজার ৮৯৩ ভোট পেয়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এনামুল হক মঞ্জু। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এডভোকেট জহিরুল ইসলাম পেয়েছিলেন ৩২ হাজার ৮৪৯ ভোট। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ৭২ হাজার ৫৯৪ ভোট পেয়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদ সিআইপি পেয়েছিলেন ৫০ হাজার ৮২৯ ভোট। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬০২ ভোট পেয়ে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদ সিআইপি পেয়েছিলেন ৭৪ হাজার ২৯৭ ভোট। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনী জটিলতায় অংশ নিতে পারেননি বিএনপির বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ। তার স্থলে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ এর সহধর্মীনি এডভোকেট হাসিনা আহমেদ। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকে অংশ নিয়েছিলেন সালাহউদ্দিন আহমদ সিআইপি। কিন্তু বিএনপি প্রার্থী হাসিনা আহমেদ এর নিকট ৩৫ হাজার ৪০১ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন বর্তমান চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম। কিন্তু মহাজোটের শরীকদল জাতীয় পার্টির সাথে আসন ভাগাভাগির কারণে শেষ পর্যন্ত জাপা প্রার্থীকে এ আসনটি ছেড়ে দিতে হয় তাকে। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় মহাজোট থেকে মনোনয়ন পেয়ে একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ ইলিয়াছ। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মহাজোট প্রার্থী হিসেবে নৌকার মাঝি হয়েছেন জাফর আলম। টানা দুই মেয়াদে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ তাদের দীর্ঘ ৪৫ বছরের পরাজয়ের গ্লানি মুছতে এবার এ আসনটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেই লক্ষ্যে চকরিয়া-পেকুয়ার পুরো নির্বাচনী মাঠে চষে বেড়িয়েছেন আওয়ামী লীগ ও তাদের দলীয় নেতাকর্মীরা। শেষ পর্যন্ত ভোটের ফলাফলে কে হচ্ছেন কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের জনগণের প্রতিনিধি সেদিকেই তাকিয়ে আছে সাধারণ ভোটাররা।