মমতার নীতিতে নেই পরিবর্তন

31

লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। তবে এই ফল বিপর্যয়ের কারণ এখনও স্বীকার করেননি দলটির প্রধান ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪টি আসনের মধ্যে ১২৬টিতে জয়লাভ করেছে বিজেপি। সিপিআই ও কংগ্রেসও ৬৫টির মতো আসন জিতেছে। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এছাড়া নিজের দল থেকে নেতাকর্মীদের বিজেপিতে যাওয়াও থামাতে পারেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই দলে বেশ কয়েকজন এমপি, এমএলএ থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত প্রধানও ছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অন্তত ৫০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বিগত ৩ বছর ধরেই এই সহিংসতা ঘটলেও থামার কোনও লক্ষণ ছিল না। অভ্যন্তরীণ রক্তপাত ঘটেই চলছে দলটিতে।
এরপরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সঠিক পথে আসছেন না। তার রাজনৈতিক ভাবধারাই হচ্ছে আক্রমণ। প্রতিপক্ষকে সম্মান দেখানোর কোনও স্থান তার মতাদর্শে নেই। কলকাতাভিত্তিক কয়েকজন পর্যবেক্ষক জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা ইস্যুর মতো বিভিন্ন বিষয়ের কারণে তার জনপ্রিয়তা কমে গেছে। অন্যদিকে বিজেপি সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও তাই চান। ফলে নতুন সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়াই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি চুক্তি করে ফেলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
স¤প্রতি রেড রোডে ঈদ উপলক্ষে দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণেও কোনও পরিবর্তনের আভাস মেলেনি। মুসলমানদের সমাবেশে বিজেপির বিরুদ্ধে স্বভাবজাত আক্রমণ চালান তিনি। অভিযোগ করেন বিজেপি ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। দিল্লির এক পর্যবেক্ষক প্রশ্ন করেন, পশ্চিমবঙ্গের ওই সভায় কতজন অবাঙালি মুসলমান ছিল, আর কতজন বাঙালি মুসলমান? এখানে প্রায় ৩ কোটি মুসলমান রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই দেশভাগের সময় বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়। এছাড়া তার দাবি, কিছু অবাঙালি মুসলমান পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর। তাদের সংখ্যা ১৮ লাখের মতো। তারা পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার, মেতিয়া বুরুজ, ওয়াটগঞ্জ, হাওড়া, ব্যারাকপুর এলাকাগুলোতে বসবাস করছে।
প্রথমে বামপন্থীরা এবং পরে কংগ্রেস নেতারা তাদের সহায়তা করে। তারা কংগ্রেসকে ভোটও দেয়। তবে কংগ্রেসের এই বন্ধসুলভ আচরণ তারা বেশিদিন মনে রাখেনি। একসময় তারা বামপন্থীদের ভোট দিতে শুরু করে। ২০১১ সালে বাম দলগুলোর পরাজয়ের পর তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন দিতে শুরু করে। উর্দুভাষী এই মুসলমানরা দিল্লির বিজেপি সরকারকে সমর্থন দিতে চায় না। তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলমান মন্ত্রী ও সাবেক মেয়র ফিরহাদ হাকিম একসময় সফররত এক পাকিস্তানি দূতকে গর্ব করে বলেওছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক অংশ এখনও করাচির মতো। রাজনীতিবিষয়ক বিল্লেষক সুবির ভৌমিক বলেন, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে যা হচ্ছে আর বাংলাদেশের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তার মিল অনেক। রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক কর্মসূচিতে যাই বলে আসুন না কেন, কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা সবসময়ই বাংলা ভাষার জন্য বাংলাদেশিদের ত্যাগের কথা স্মরণ করেন ও শ্রদ্ধা জানান। বাংলাদেশিদের জন্য তাদের ভালোবাসারও কমতি নেই। বিপরীতে, কলকাতাবাসী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আসামের বরাক উপত্যকা থেকে যারা এসেছেন, তাদেরও ভাষার চরম আত্মত্যাগের ঘটনা আছে। সেখানেও ভাষার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে ১১ জনকে।
পশ্চিমবঙ্গে ১৯৪৭ সালে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ১৫ শতাংশ। আর এখন তা বেড়ে ৩০ শতাংশ। কাশ্মির ও আসামের পরে এখানেই সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস। বাম দল, কংগ্রেস ও তৃণমূল—সবাই মুসলমানদের তাদের ভোট ব্যাংক বানানোর চেষ্টা করেছে। এত বছর তৃণমূল কংগ্রেসও তাদের সবচেয়ে বড় ভোট ব্যাংক ভাবতো মুসলমানদের। তবে এবারের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ধাক্কা খাওয়ার কারণ দলটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিজেপি বা অন্য দলগুলোকে ভোট দিয়েছে মুসলমানদের একটি অংশ। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলমান ভোটারদের যে একচেটিয়া সমর্থন পেয়ে আসছিল, এবারই তাতে এত বড় আঘাত লেগেছে।