মনের জানালা যতটা পারেন প্রসারিত করুন

334

জীবন পুষ্পশয্যা নয়-জীবন বড়ই জটিল। এ কারণেই হয়তো কবি হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় সংসারকে তুলনা করেছেন সমরাঙ্গনের সঙ্গে । কোনো মানুষ সারা জীবন সুখে কালাতিপাত করতে পারবেন তার চুল পরিমাণ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন না। আজ হয়তো আপনি রাজার হালে আছেন কাল যে আপনার জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ রকমই ঘটছে পরিবারে, সমাজে, দেশে-দেশান্তরে।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা এ রকম নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার প্রত্যক্ষ করি। পারিবারিক জীবনের জটিলতা, জীবনযাপনে প্রতিকূলস্রোত, প্রিয়জনের বিচ্ছেদজনিত ঘটায় আমরা কখনো কাতর কখনো পাথর হয়ে পড়ি। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বরং না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। কারণ মানুষ মাত্রই আবেগপ্রবণ। যেকোনো ঘটনা ঘটনার স্থান কাল পাত্র অনুযায়ী একজন মানুষের ভেতরে যে সফট কর্নার আছে সেখানে রেখাপাত করে। আবার সব মানুষের আবেগ প্রশমনের ক্ষমতা সমান নয়। কেউ দিবালোকে খুন করে হাসতে হাসতে স্থান ত্যাগ করে। আর কেউ রাগের বশে ঘটনা ঘটানোর পর আপনা আপনি থানায় গিয়ে ধরা দেয়। অনেক সময় খুনি নিজেই আত্মঘাতী হয়। তাই দুঃখশোকে, বিপদে-আপদে, সুখে-অসুখে এক একজন এক এক রকম ভাবে নিজের ভেতরের অবস্থা প্রকাশ করে।
চলার পথে আমরা অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনার মুখোমুখি হই, যেগুলো কখনো আমাদের ক্ষুব্ধ করে, কখনো আমাদের চোখে মুখে ছড়িয়ে দেয় বিষাদের কালো ছায়া, আর কখনো করে ব্যথিত। আসলে এ সব প্রতিক্রিয়ার অপর নামই জীবন। এ ক্ষুদ্র জীবনে প্রতি মুহূর্তে আমরা পেতে পারি দুঃখের হাতছানি, হতে পারে দু’চোখ পানিতে টলমল। ঘটতে পারে নানা বিপদ, ভেঙে যেতে পারে আশার বসতি। এ সবের মধ্যেই নদীর প্রবাহমান স্রোতের মতো এগিয়ে চলে মানুষের জীবন। নদীর যেমন জোয়ার ভাটা আছে- মানুষের জীবনেও আছে জোয়ার ভাটা। মনে রাখতে হবে সুখ দুঃখ দিন রাতের মতোই মানুষের জীবনে আসা যাওয়া করে। আঁধারের পর সূর্য উঠবেই এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতির এ নিয়মের যেমন কোন ব্যত্যয় ঘটে না তেমনি মানুষের জীবনে অপ্রত্যাশিত ঘটনার বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটবে তা কখনো নয়। তাই কোনো দুঃখের ঘটনা, কষ্টের মুহূর্ত কিংবা মর্মযাতনার কথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মন থেকে মুছে ফেলা যায় ততই মঙ্গল।
মনে কষ্ট জিইয়ে রেখে পথ চলার মতো কষ্ট পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এর ফলে মানুষ কাজকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কোনো কাজের প্রতি তার মন সায় দেয় না, কোথাও বেড়াতে যেতে বা কারও সঙ্গে মিশতে তার ইচ্ছে করে না। জীবনটাকে মনে হয় নিরস, একঘেয়ে, অর্থহীন। জগত সংসার বা প্রিয়জনের প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকে। এ ধরনের অবস্থা কোনে মানুষের কাম্য হতে পারে না।
আমাদের সমাজে যেকোনো কারণেই হোক কষ্ট পুষে রেখে পথ চলার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। হৃদয়ঘটিত কারণে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি হলেও যে কোনো বয়সের মানুষ বিশেষত চাপা স্বভাবের মানুষের মধ্যেও এই প্রবণতা বেশি। কষ্ট পুষে রাখার মতো কোনো বিষয় নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কষ্টের মূল উৎপাটন করা দরকার। কষ্ট নিয়ে পথ চললে এক সময় জীবনটা চরম অর্থহীন ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। তাই দ্রæত মন থেকে কষ্ট মুছে ফেলার উপায় খুঁজতে হবে। কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো মনের শক্তি বাড়ানো। নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন। লোকে আপনাকে যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন আপনার কাছে আপনার জীবনটা খুবই মূল্যবান। এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে আপনার দেখার, জানার, শোনার, করার অনেক কিছুই আছে। তাই যাপিত জীবনের কোনো ঘটনা নিয়ে দুঃখের ভারে নুয়ে পড়ে দেবদাস সেজে জীবনটাকে দুর্বিষহ করার বদলে জীবনের জয়গান গাওয়ার চেষ্টা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এ জন্য মনোবিজ্ঞানীরা যা করার বা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন সেগুলোর উপর একবার চোখ রাখতে পারেন। বলা তো যায় না কখন কোন ঔষধে কাজ করে, তাই জেনে রাখতে দোষ কি!
১. আপনার কষ্টের কথা, মর্মবেদনার কথা, কারো উপর ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা আপনার মনের গভীরে লুকিয়ে না রেখে তা অতল সাগর থেকে তুলে এনে কারো সাথে শেয়ার করুন। শেয়ার করার মানুষটি হতে পারে আপনার মা, বাবা, বন্ধু, ভাইবোন, স্ত্রী অথবা আপনার বিশ্বস্থ কোনো সহকর্মী বা প্রতিবেশি। মনে রাখবেন সামান্য একজন মানুষও এ ব্যাপারে অনেক কাজে লাগতে পারে। পিঁপড়েও যে মানুষের উপকার করতে পারে সাধারণ চোখে তা ধরা না পড়লেও এটাই সত্য। সুতরাং যাঁর উপর নির্ভর করা যায়, বিশ্বাস করা যায় তেমন কাউকে আপনার কষ্টের কথা প্রাণখুলে অকপটে বলে ফেলুন। এতে আপনার কষ্টের ভার নিশ্চিত অর্ধেক কমে যাবে। ২. কান্নাটা যত সহজে চোখে নামে, হাসিটা বার বার চেষ্টা করেও চোখে মুখে ফুটিয়ে তোলা যায় না। এ কারণে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা বলেছিলেন, বাঙালি শুধু কাঁদতে জানে হাসতে জানে না। আসলেই তাই, হাসাটাই কষ্ট। তাই তো মানুষকে হাসানোর জন্য গোপাল ভাঁড়ের মতো যুগে যুগে অনেকেই চেষ্টা করেছেন, চেষ্টা করে যাচ্ছেন। লক্ষণীয় যে, হাসার জন্য বা হাসাবার জন্য শত শত বই থাকলেও কান্না শেখাবার জন্য অদ্যাবধি কোনো বই লেখা হয়নি। তাই হাসাটা কঠিন হলেও দুঃখ পাওয়ার পরক্ষণে হাসার চেষ্টা করুন। হাসি মানুষের দুঃখকে অনেকাংশে ভুলিয়ে দেয়। হাসিতে দুঃখের ভার যতটা হালকা হয় অন্য কিছু দিয়ে তা মোটেই সম্ভব নয়।
৩. যখন মন খারাপ হয় তখন অনবরত কথা বলুন। কথা বলার মতো লোক সব সময় পাওয়া যাবে এমন কোনো কথা নেই। এ অবস্থায় কী করবেন? বই নিয়ে বসে পড়ুন। মজার কোনো বই। বইয়ের মতো বিশ্বস্থ বন্ধু পৃথিবীতে একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
৪. কাজে লেগে পড়ুন-ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করুন। একা একা বসে থাকলে সাত রাজ্যির চিন্তাগুলো আপনার মাথায় এসে ভর করতে পারে। কষ্টগুলো ডানা মেলে ঝাপটাতে পারে। তাই কষ্টের ঘাড় মটকে দিন।
৫. মনকে বশ মানাতে শিখুন। মনকে বশ মানানো খুব একটা সহজ নয়। কারণ সব কাজে খবরদারি চলে, শুধু খবরদারি চলে না মনের উপর। তবু আমাদের চেষ্টা চালাতে হবে মনকে বশ বানানোর। নিজের উপর গভীর আস্থা রাখুন। আস্থা আপনাকে নিশ্চিত রাস্তা বাতলিয়ে দিতে পারে। নিজেকে কখনো অযোগ্য বা ছোটো ভাববেন না। মনে রাখবেন-আমরা সবাই রাজা / আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
৬. অন্যদের সঙ্গে নিজের তুলনা করুন। আপনার আশপাশেই দেখতে পাবেন কত লোক, কেউ চোখ থাকিতে অন্ধ, কারো অঢেল বিত্ত আছে কিন্তু কোনো ছেলেমেয়ে নেই। যিনি অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি তো নিজের প্রিয়তম মা-বাবার মুখটিও দেখতে পাননি। দেখতে পান না এই অপরূপ পৃথিবীর রূপ রস। তাঁর চেয়ে দুখি মানুষ আর কেউ কী হতে পারে এ ভুবনে? এভাবে আপনার আশপাশের মানুষের কথা ভাবুন দেখতে পাবেন তাঁদের চেয়ে আপনি কতটা সুখি কিংবা তাদের তুলনায় আপনার দুঃখ বা কষ্ট কত কম।
৭. কথায় বলে আশার মায়ের মৃত্যু নেই – অর্থাৎ সব কিছুর শেষ আছে, আশার কোনো শেষ নেই। তাই আশাকে জিইয়ে রাখুন। কারণ আশা মানুষকে সঞ্জীবনী শক্তি যোগায়। এ সঞ্জীবনী শক্তি অনায়াসে আপনার মনের কষ্ট দূর করে আপনাকে পৌঁছে দিতে পারে হিমালয়ের অদেখা ভুবনে।
৮. সবচেয়ে বড় কথা দুঃখকে জয় করতে শিখুন। দুঃখকে কখনো পাত্তা দেবেন না। জীবনে যত দুঃখই আসুক তা স্বাভাবিকভাবে নেয়ার চেষ্টা করুন।“বপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়” কবি গুরুর এই বিখ্যাত চরণ কয়টি বারবার স্মরণ করুন।
এই পরামর্শের কোনটি আপনার কাজে লাগতে পারে সেটি আপনিই ভালো বুঝবেন। তবে দুঃখ তাপে ব্যথিত চিত্তে সান্ত¡না না পেলেও নিজের জন্য হলেও দুঃখকে জয় করার চেষ্টা করুন। এ জন্য প্রয়োজন আপনার মনের জানালাটা যতটা সম্ভব প্রসারিত করা। উনিশ শতকের কবি কামিনী রায়ের ভাষায় তাই বলা যায়-
বিষাদ-বিষাদ-বিষাদ বলিয়ে
কেনই কাঁদিবে জীবন ভরে?
মানবের মন এত কি অসার?
এতই সহজে নুইয়ে পড়ে?
লেখক ঃ শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক