মনের কথা পড়তে পারা রোবট স্যুট

27

মস্তিক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন একটি ‘রোবটিক স্যুট’ পরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক মানুষ তার অবশ হাত-পা নাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। ফরাসী গবেষকরা বলছেন, থিবল্ট নামে ৩০ বছর বয়সী এক ফরাসী, যিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত, তার ওপর এই পরীক্ষাটি চালানো হয়। তাকে একটি ‘এক্সোস্কেলেটন স্যুট’ পরানো হয়েছিল। এটি তার মস্তিস্কের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সেটি পরে তিনি কয়েক ধাপ হাঁটতে পেরেছেন। থিবল্ট তার এই হাঁটার অভিজ্ঞতাকে চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষের পা রাখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
গবেষকরা বলছেন, থিবল্ট যেভাবে হেঁটেছেন সেটা যে একেবারে শতভাগ ঠিকঠাক ছিল, তা বলা যাবে না। তিনি এক্সোস্কেলেটন স্যুট পরে গবেষণাগারের ভেতরেই শুধু এই হাঁটার পরীক্ষা চালিয়েছেন। কিন্তু গবেষকরা আশাবাদী, এই পরীক্ষা ভবিষ্যতে পক্ষাঘাতে আক্রান্তদের জন্য বড় সুখবর নিয়ে আসতে পারে। তাদের জীবনমানে নাটকীয় উন্নতি ঘটাতে পারে। খবর বিবিসি বাংলার
কিভাবে এটি কাজ করে?
থিবল্টের মাথায় অস্ত্রোপচার করে তার মস্তিস্কের ওপর দুটি ইমপ্ল্যান্ট বসিয়ে দেয়া হয়। মস্তিস্কের যে অংশটি মানুষের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে যুক্ত করা হয়েছিল এসব ইমপ্ল্যান্ট। প্রতিটি ইমপ্ল্যান্টে ছিল ৬৪টি ইলেকট্রোড। মস্তিস্কের ভেতরে কি হচ্ছে তা মনিটর করতে পারে এসব ইমপ্ল্যান্ট। এরপর তারা মস্তিস্কের এই সংকেত পাঠিয়ে দেয় নিকটবর্তী এক কম্পিউটারে। অত্যাধুনিক এক কম্পিউটার সফ্টওয়্যার দিয়ে এসব সংকেত পড়া হয়। এরপর সেই সংকেত অনুযায়ী এক্সোস্কেলেটন ড়–্যটের কাছে নির্দেশ যায় কি করতে হবে।
থিবল্টের শরীর বাঁধা ছিল এই এক্সোস্কেলেটন স্যুটে। থিবল্ট যখনই ভাবছেন তিনি হাঁটবেন, মস্তিস্ক থেকে সংকেত যাচ্ছে কম্পিউটারে, কম্পিউটার থেকে আসা নির্দেশে এরপর এক্সোস্কেলেটন স্যুট তাকে হাঁটাচ্ছে। এভাবে কেবল তার চিন্তা দিয়ে থিবল্ট তার দু’হাতও নানা ভাবে নাড়াতে পারেন।
এটি ব্যবহার করা কতটা সহজ?
থিবল্ট তার নামের শেষ অংশ প্রকাশ করতে চান না। তিনি ছিলেন একজন অপটিশিয়ান। চার বছর আগে একটি নাইট ক্লাবে এক ঘটনায় তিনি পড়ে গিয়ে আঘাত পান। তার স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরের দু’বছর তাকে অবশ শরীর নিয়ে হাসপাতালে কাটাতে হয়। তবে ২০১৭ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব গ্রেনোবেল এবং ক্লিনাটেকের এই পরীক্ষায় অংশ নেন।
শুরুতে তার মস্তিস্ক দিয়ে তিনি একটি কম্পিউটার গেমে একটি ‘ভার্চুয়াল ক্যারেক্টার’ পরিচালনা করতেন। এরপর তিনি এক্সোস্কেলেটন স্যুট পরে হাঁটতেও সক্ষম হন। থিবল্ট বলেন, ‘এই অভিজ্ঞতাটা ছিল প্রথম চাঁদের মাটিতে হাঁটার মতো। আমি দু’বছর হাঁটতে পারিনি। কিভাবে দাঁড়াতে হয় সেটা পর্যন্ত আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার রুমে অনেক মানুষের চেয়ে যে আমার উচ্চতা বেশি, সেটাও আমি ভুলে গিয়েছিলাম’।
তবে দুই হাত কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সেটা শিখতে থিবল্টের অনেক সময় লাগে। থিবল্ট বলেন, ‘এটা খুব কঠিন ছিল। কারণ এখানে এক সঙ্গে অনেক কটি পেশীকে নানাভাবে নাড়াতে হয়। তবে এক্সোস্কেলেটন স্যুট দিয়ে যত কাজ করা যায়, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে চমৎকার’।
এক্সোস্কেলেটন কতটা কাজের?
এক্সোস্কেলেটন স্যুটটির ওজন প্রায় ৬৫ কেজি। এটি কার্যত একটি অত্যাধুনিক রোবটিক স্যুট। যেটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় মস্তিস্কের চিন্তা দিয়ে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তির সবধরণের চলাফেরায় যে এটি সাহায্য করতে পারে তা নয়। তবে আগের গবেষণার চেয়ে এবারের সাফল্যকে বিরাট অগ্রগতিই বলতে হবে। আগের পরীক্ষাগুলোতে মস্তিস্ক দিয়ে বড় জোর একটি হাত নাড়ানো যেত।
এবারের পরীক্ষার সময় অবশ্য থিবল্টকে সিলিং থেকে ঝোলানো দড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল, যাতে হাঁটার সময় তিনি পড়ে না যান। এ থেকে বোঝা যায় এই নতুন প্রযুক্তি এখনো গবেষণাগারের বাইরে ব্যবহারের উপযোগী নয়।
ক্লিনাটেকের নির্বাহী বোর্ডের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর আলিম লুইস বেনাবিড বলেন, ‘এখনো নিজে নিজে হাঁটার মতো প্রযুক্তি এটি হয়ে উঠতে পারেনি। যাতে পড়ে না যান, সেজন্যে যতটা দ্রুত এবং যেভাবে তার নড়াচড়া করা দরকার, সেটা থিবল্ট করতে পারেন নি’।
থিবল্টকে তার এক্সোস্কেলেটন স্যুট পর যেভাবে হাত নাড়াতে এবং কব্জি ঘোরাতে বলা হয়েছিল, তার ৭১% ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন।
প্রফেসর বেনাবিড এর আগে মস্তিস্কের গভীরে উদ্দীপনা সৃষ্টির মাধ্যমে পার্কিনসন্স রোগের চিকিৎসায় সফল হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সমস্যার সমাধান করেছি এবং দেখিয়েছি যে এই ধারণাটি কাজ করছে। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে এক্সোস্কেলেটন ব্যবহার করে রোগীদের চলাফেরায় সাহায্য করা সম্ভব’।
এরপর কি ঘটবে?
ফরাসী বিজ্ঞানীরা বলছেন, তারা এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করার জন্য কাজ করে যাবেন। বর্তমান প্রযুক্তির বড় কিছু সীমাবদ্ধতা এখনো রয়ে গেছে। যেমন মস্তিস্ক থেকে যেসব তথ্য কম্পিউটারে যাচ্ছে, তার অল্পই তারা পড়তে পারছেন। এরপর এই তথ্য বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে কম্পিউটার যখন এক্সোস্কেলেটন স্যুটে পাঠাচ্ছে, সেটাও খুব ধীরে। মস্তিস্কের চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়ানোর কাজটি করতে হয় ৩৫০ মিলিসেকেন্ডের মধ্যে। নইলে এই পদ্ধতি ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
তার মানে হচ্ছে যে ৬৪টি ইলেকট্রোড মস্তিস্কের সঙ্গে সংযুক্ত, তার মাত্র ৩২ টিকে গবেষকরা কাজে লাগাতে পারছেন।
কাজেই মানুষের মস্তিস্কের ভেতরে কি ঘটছে সেটা আরও বিস্তারিতভাবে জানার সম্ভাবনা এখনো রয়ে গেছে, এজন্যে দরকার হবে আরও শক্তিশালী কম্পিউটার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ভবিষ্যতে আঙ্গুলের নড়াচড়াও যাতে এভাবে মস্তিস্কের চিন্তা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই পরিকল্পনা চলছে। এর ফলে থিবল্ট ভবিষ্যতে তার হাত দিয়ে জিনিসপত্রও তুলতে এবং নাড়াতে পারবেন।
এরই মধ্যে থিবল্ট তার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে একটি হুইলচেয়ার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
এই প্রযুক্তিকে কি কোনো অশুভ কাজেও লাগানো যাবে?
এক্সোস্কেলেটন ব্যবহার করে মানুষের কার্যক্ষমতা কিভাবে আরও বাড়ানো যায় তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই গবেষণা ক্ষেত্রটির নাম ‘ট্রান্সহিউম্যানিজম’। সামরিক ক্ষেত্রেও এটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে প্রফেসর বেনাবিড বলেন, তাদের গবেষণা কখনোই এরকম চরম বা নির্বোধ দিকে যাবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এই গবেষণা করছি না। আমাদের গবেষণার লক্ষ্য কোনো আঘাতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া রোগীদের সাহায্য করা’।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক টম শেক্সপীয়ার বলছেন, ‘এই গবেষণা যদিও একটা রোমাঞ্চকর সাফল্য নিয়ে এসেছে, আমাদের মনে রাখতে হবে যে একটা ধারণাকে প্রমাণ করা আর এটিকে বাস্তবে প্রয়োগ করার মধ্যে বিরাট ফারাক আছে। এটাকে যদি কখনো কাজে লাগানো সম্ভবও হয়, এরকম অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এতটাই ব্যয়বহুল হবে যে, তা বিশ্বে স্পাইনাল কর্ডের আঘাতে ভুগছেন যারা, তাদের বেশিরভাগের সাধ্যের বাইরে থাকবে’। তিনি জানান, বিশ্বে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের মাত্র ১৫ শতাংশের হুইলচেয়ার আছে।