মনাম এর বৈঠকখানা

63

১৯৮৭ সালের আগস্ট মাস থেকে চট্টগ্রামের একটি নিয়মিত মাসিক পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় বৈঠক খানা। তখন হইতে মাঝখানে কয়েক মাস ছাড়া বিরতিহীন ছুরতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটানা ত্রিশ বছর বৈঠক খানা চলিয়াছে। আজকের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক বৈঠকখানা পড়িয়া বড় হইয়াছে। মাগার ছদ্মনামে লিখিতাম বলিয়া অনেকেই লেখককে চিনিতেন না। দীর্ঘ তিন বছর পর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক অধ্যক্ষ আবু তালেব বেলাল ভাইয়ের অনুরোধে আবারও আরম্ভ করিলাম পাঁচ মিশালি ভাষার রম্য কলাম ‘বৈঠকখানা’।
শীত আরম্ভ হইয়াছে। শীতের কুয়াশা থামিয়া থামিয়া ঝরিতেছে। যেন পিতৃ হারা কোন এতিমের বাঁধভাঙা অশ্রæ ঝরিতেছে। করোনায় অনেক পরিচিত ইয়ার দোস্তকে হারাইয়া বাকরুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছি। অনেক ব্যবসায়ী, সমাজ সেবক, জনপ্রতিনিধি, ডা. ও পুলিশের লোকও করোনা আক্রান্ত হইয়া বিদায় নিয়াছে। তাই বোধহয় আকাশটা শোকে মেঘাচ্ছন্ন। এই কঠিন আত্মীয় অনাত্মীয় পর-আপন চিনিবার পরীক্ষায় সত্যিকারের আপনজন হইয়া ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল করোনাক্রান্ত রোগীর দাফন, সৎকারে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করিয়া মানবতার সেবায় যাহারা সর্বপ্রথম আগাইয়া আসিয়াছে সেই গাউসিয়া কমিটি প্রশংসা পাইবার যোগ্য। ইহাতে আবারও প্রমাণ হইল ইসলামই সত্যিকারের মানবতার ধর্ম। গুলবদনের ভাইরাস জ্বরে তামাম পরিবার আতংকের মাঝে সপ্তাহ গুজারিয়া এখন খানিকটা ধাতস্থ হইয়াছি। বিপন্ন ইনসান দড়ি দেখিলে সর্প ভাবিয়া দৌড়াইতে থাকে। তামাম দুনিয়া করোনা ভয়ে ইষ্ট নাম জপ করিতেছে। সকাল -সন্ধ্যা শোক সংবাদের মাইকিং শুনিতে শুনিতে শরীর ও মন নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে। জিন্দেগীটা যেন খেজুর গাছে লটকিয়া আছে। যে কোন মুহূর্তে করোনা ঝড়ে ঝরিয়া পড়িতে পারে। করোনা টেনশনে তামাম কিছু তিত করোলা হইয়া গিয়াছে। এত পেরেশানিতে নতুন ছুরতে পেরেশানি দিতেছে আবাসিক এলাকার জ্বালানি গ্যাস । শীতকাল আসিলে গ্যাস সংকট বাড়িয়া যায়। কোন কোনদিন যায় তো আর আসার নামগন্ধ থাকে না। এত পুরাতন লাইনগুলি সংস্কার করা এখন নেহায়েত জরুরি। করোনা কালের প্রথমদিকে তিন মাস গ্যাস-বিদ্যুৎ এর বিলম্ব ফি মওকুফ করিলেও পরে একত্রে তিন মাসের বিল দিতে অনেককে নাকানিচুবানি খাইতে হইয়াছে।সরকার বাহাদুরের পরামর্শ দাতাদেরও আজব বিচক্ষণতা। তাহারা হামেশা লাকড়ি আর বকরি একই পাল্লায় মাপিয়া থাকেন। কয়েক দিন আগে মাস্টার সাহেব কহিয়াছিলেন, তিনি সর্বত্র ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইতেছেন। রাজনীতির ঘুমন্ত শয়তান নড়িয়া-চড়িয়া উঠিতেছে। জায়গা বেজায়গায় চুলকানি আরম্ভ হইয়াছে।
আসরের নামাজ পড়িয়া মসজিদ হইতে বাহির হইতেই মাস্টার সাহেবের সাথে দেখা। মাস্টার সাহেব আমাদের এলাকায় নতুন আসিয়াছেন। আমাদের পাশেই ভাড়ায় থাকেন। একসময় সরকারি চাকুরি করিতেন। পোস্ট মাস্টারের চাকরি হইতে অবসর নিয়া এখন এক ছেলে এক মেয়ে লইয়া সপরিবারে চট্টগ্রামে স্যাটেল্ড হইবার এরাদায় বর্তমানে আমাদের এলাকায় থাকেন।ছেলেটা চাকরী করে একটি প্রাইভেট ফার্মে। মেয়েটা কলেজে পড়ে। লেখা-লেখি করি শুনিয়া তিনি আমার সহিত পরিচিত হইতে একেবারে বেচাইয়েন হইয়াছিলেন। সকিনার বাপের মাধ্যমে আমার নিকট আগমন। গল্প-গুজব করিয়া ভালই লাগিয়াছে। জিন্দা দিল ইনসান। মাঝে মাঝে নয় প্রায়ই আসিয়া থাকেন আমার সহিত আড্ডা দিতে। মসজিদেও দেখা হয়। আজ তাহার হাতে বাজারভর্তি থলি। তবুও তিনি আমার সহিত আলাপ না করিয়া একপা আগে বাড়িবেননা। টানিয়া রাস্তার একপাশে লইয়া গেলাম। মুখে ভক্তির হাসি। মাস্কটা চিবুকের কাছে টানিয়া কহিলেন, আপনি তো কাগজে লেখেন। প্রত্যেক বার বাজেটের সময় মানুষ আতংকে থাকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামে যেন বাজেটের কুপ্রভাব না পড়ে। কিন্তু বাজেটের ধর্ম বাজেট পালন করিয়া গেলেও অর্ধ বর্ষ গুজারিয়া গেলেও বর্তমানে করোনার বাহানা, ঝড় বৃষ্টির বাহানায় সবজির সাথে সাথে মাছ-মাংসের দামও বাড়িয়া গিয়াছে। মাস্টার সাহেবের কথা শুনিতে আশে-পাশে আরও দুয়েক জন বুকে হাত বাঁধিয়া খাড়াইয়া গেল। বাঙালি অতি উৎসাহি জাতি। তামাম খবর তাহার জানিতে হইবে। নগদ বাকি, তাজা বাসি সব খবর। যেইখানে জটলা সেইখানে খাড়াইয়া যায় হাতে লইয়া পোটলা। আমি তছল্লির হাসির তজল্লি ছড়াইয়া মৃদু গলায় তাহাকে কহিলাম- বিনা টিকেটের দর্শক জমা হইয়া যাইতেছে। ঘরে যান, বাজার রাখিয়া আসেন। বৈঠকখানায় বসিয়া আলাপ করিব। মাস্টার সাহেব জো-হুকুম কহিয়া বাসার তরফ রওয়ানা হইলেও আমার অন্তরে শান্তি নাই। আসলে আমি মাস্টার সাহেবকে কি জওয়াব দিবো। করোনা’র জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখিবার মুখস্ত পাঠে এতই আত্মকেন্দ্রিক হইয়া পড়িয়াছি স্বজনের মৃত্যু শুনিয়াও দাফন -কাফনে গমন হইতে বিরত থাকিতে হয়। বিবাহ,শাদী, খতনা আক্বিকা হইতেছে মাগার দাওয়াত নাই, যাওয়ার তাগাদাও নাই। যদিও শাহীভোজ হইতে বঞ্চিত হইয়া চিত্ত কন্দরে বিরহ বন্দরে আফসোস এর রক্ত ক্ষরণ হইয়া থাকে। পঞ্চ ব্যঞ্জনায় রসনা সিক্তকারী বাঙাল করোনা কালে বিলকুল মিছকিন হইয়া আসমানের তরফ তাকাইয়া আছে। যদিও এইটা মুসা নবীর জমানা নয় যে মান্না -ছালওয়া আসিবে। বেওফা বান্দাদের জন্য মান্না -ছালওয়া আসিবার কথাও না। পরম করুণাময় এর করুণায় এই যাত্রায় মহামারি করোনা ভাইরাস হইতে মুক্তি পাইলে তাহাই হইবে এই জমানার পরম পাওয়া “মান্না ছালওয়া ”। মাগার তাহা ফওরান হইবে বলিয়া মনে হইতেছে না। গুলবদন সুস্থতা লাভের পর মেহেরজানের সামান্য জ্বর জ্বর ভাব আসিলে সকলে চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলাম। লেকিন মেহেরজান সহসাত চিন্তা হইতে মুক্তি দিয়াছিল। কাজের বুয়া হারুর মা গোলাম আলীকে কহিতে শুনিলাম – মেহেরজানের জ্বরটা নাকি হতিন্যা জ্বর। গুলবদনের যাহা লাগিবে মেহেরজানের ও ঠিক তাহাই লাগিবে। গুলবদন যাহা খাইবে, পিন্দিবে মেহেরজানের ও তাহা তাহাই লাগিবে। গুলবদন ভুলে যদি একটা উষ্টা খায়, মেহেরজানকেও আরেকটা উষ্টা খাইয়া হতিন্যে ভাগের প্রমাণ রাখিতে হইবে। আমি ভয়ে থাকি তাহাদের হাছদ দেখিয়া। কোনদিন রেষারেষি করিতে যাইয়া নামাজে না আবার সজিদা একজনে দুইটা দিলে অন্যজনে চারটি মারিয়া দেয়ার তালে থাকে। তাহাদের ঝগড়া লইয়া আমি বহুত পেরেশানিতে আছি। আচানক সকিনার বাপ আসিয়া হাজির। কোনকিছু জিজ্ঞাসা করিবার আগেই ¤øান মুখে কহিলেন-পাড়াতুতো চাচা ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। পাথরের মতো শক্ত হইয়া গেলাম। কাহারো মৃত্যু সংবাদ শুনিলে আগের মত নড়িয়া চড়িয়া উঠি না। অনড় অটল থাকিয়া শক্ত হইয়া যায়। এক এক করিয়া চেনা জানা লোকগুলিই যেন নিরুদ্দেশ হইয়া যাইতেছে করোনা এক্সপ্রেসে চাপিয়া। চাচার সহিত কিছু স্মৃতি রহিয়া গেল। মাস্টার সাহেব বাচ্চাদের আদব আখলাকের কথা লইয়া গত সপ্তাহে বৈঠকখানায় কিঞ্চিৎ আলোচনা করিয়াছিলেন। আজকাল ম্যানার বলিতে কিছুই নাই। ম্যানার শব্দটা যুবসমাজের অভিধান হইতে নিরুদ্দেশ । অগ্রজদের সম্মান প্রদর্শন না করিলে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হইবে অগ্রজের কিছুই হইবে না।
যিনি প্রকাশ্যে মানুষকে হেনস্তা করিয়া নিজেকে মহাপÐিত ভাবিয়া থাকেন তিনি হয়তো অশিক্ষিত নয়তো মানসিকভাবে অসুস্থ। তামাম কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিখাইবে এহেন ধারণা ভুল। প্রতিদিনের চলার পথেও মানুষ অনেক কিছু শিখিয়া থাকে । গোটা পৃথিবী একটা পাঠশালা । কিন্তু সব চোখ শিখিবার চোখ নয়। প্রবাসজীবনে একদা একটা বাংলাদেশি হোটেলে চা খাইতে ঢুকিয়া দেখিলাম হোটেলের ভেতর টিভিতে বিশ্বকাপ চলিতেছে। লোকেরা সবাই টিভির তরফ তাকাইয়া আছে আর হৈ হুল্লোড় করিতেছে। দোকানের কর্মচারীরাও বুকে হাত বাঁধিয়া খাড়াইয়া খাড়াইয়া টিভি দেখিতেছে। এক পাকিস্তানি পাঠান ঢুকিয়া টেবিলের জগে পানি না দেখিয়া এক কর্মচারীকে কহিলেন— হে ভাই, তুম ইদার বেইঠো, ম্যাই জেরা পানি লে-কার আতা হু ( হে ভাই তুমি এখানে বসো, আমি একটু পানি নিয়ে আসি।)। কাস্টমার হিসাবে পাঠান বলিতে পারিতেন – হে ভাই, পানি মাংতা। পানি লও। মাগার পাঠানের ম্যানার দেখিয়া আমি অভিভূত। পাঠান পাঠানের বলার ভংগিতে কর্মচারীটি লজ্জিত হইয়া দ্রæত পানি আনিতে চলিয়া গেল। এক কিতাবে পড়িয়াছিলাম, হযরত হোসাইন (রাঃ) শিশু অবস্থায় খাড়াইয়া খাড়াইয়া এক বৃদ্ধ সাহাবীর অজু করা দেখিতে ছিলেন যার অজু করা শুদ্ধ ছিল না। লেকিন আদবের বরখেলাপ হইবে দেখিয়া বলিতেও পারিতেছেন না “আপনার অজু হয়নি”। মাগার এই সাহাবির অজু শুদ্ধ করিয়া দিতে হইবে। তাই বলিলেন – একটু দাঁড়ান, আমি অজু করছি আমার অজু শুদ্ধ হচ্ছে কিনা একটু দেখবেন। সাহাবিও খাড়াইয়া খাড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন শিশু হযরত হোসাইন রাঃ এর অজু করা। অজু শেষে সাহাবি কহিলেন আপনার অজু বিলকুল ছহি হয়েছে। বরং আমার অজুতেই গলদ ছিল। এই বলিয়া তিনি পুনরায় অজু করিলেন। এটাকেই বলে ম্যানার। আদব,বিনয়,ভদ্রতা এগুলো না থাকিলে আপনার পর্বত সমজ্ঞানের কোন দাম নাই। মোয়াল্লেমুল মালাইকা আজাজিল অনেক জ্ঞানের অধিকারী ছিল। লেকিন আল্লাহর আদেশ অমান্য করিয়া হযরত আদম আলাইহিসালাম কে সম্মান প্রদর্শন না করাই আল্লাহ পাক অসন্তুষ্ট হইয়া তাহার তামাম আমল বরবাদ করিয়া লা’নতের লেবাস পিন্দাইয়া দিয়াছিলেন। হইয়া গেল ইবলিশ শয়তান। তাহার এত ইবাদত, এত জ্ঞান কোনো কাজে আসিলনা । তারপরেও কী বেত্তমিজ শয়তানের চেলাদের জ্ঞানের দরজায় লাগানো অহংকার আর নির্বুদ্ধিতার ছিটকানি খুলিয়াছে ?

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক