মঞ্জুরার কান্না

87

আব্দুস সালাম

মঞ্জুরা বয়সের ভারে নুব্জ। ভিক্ষা করা তার পেশা। বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে সে ভিক্ষা করে। একটি অজপাড়া গাঁয়ের মেঠো পথের ধারে ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘরে বাস করে। তার বয়সের আরো দুই একজন বৃদ্ধাকে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে থাকতে দেখা যায়। তারাও ভিক্ষা করে। মঞ্জুরা কবে থেকে ওই গ্রামে বসবাস শুরু করেছে আজ আর কেউ বলতে পারে না। সকলে জানে সে ফৌজদারী পাড়ার একজন বাসিন্দা। বৃদ্ধা মঞ্জুরাকে দেখলে কারোর বুঝতে কষ্ট হবে না যে সে যৌবনকালে খুব রূপসী ছিল। অসহায় বয়স্ক নারী হিসেবে সকলেই কমবেশি তাকে ভিক্ষা দেয়। নন্দপুর গ্রামের মালেক মিয়া শুধু একজন ধনীই নয়, উদার ও বড় মনের মানুষ। অসহায় গরিবদের ভালোবাসে। বিপদে-আপদে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। ফকির মিসকিন তার বাড়িতে এসে কেউ খালি হাতে ফিরে যায় না। বিঘে দুয়েক জমির ওপর তার বাড়ি। বাড়ির শেষ প্রান্তে একটি পাকুড়গাছ দাঁড়িয়ে আছে। লোকজনদের বিশ্রামের জন্য সে গাছের নিচে একটা মাচা তৈরি করে দিয়েছে। লোকজনরা গাছের ছায়ায় এসে বিশ্রাম করে। মালেক সাহেবের স্ত্রীও তার মতো উদার ও ধার্মিক। ফকির মিসকিনের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করে না। তাই নন্দপুর গ্রামে মঞ্জুরা এলে মালেক সাহেবের বাড়িতে যেতে ভুল করে না। আসা-যাওয়ার পথে মঞ্জুরাও মাচায় বসে বিশ্রাম করে।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে গ্রামের স্কুলমাঠে সকাল থেকেই নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ওইসব অনুষ্ঠান দেখার জন্য সকাল থেকেই সববয়সের লোকজন স্কুলমাঠে ভীড় করেছে। এমনদিনেও মঞ্জুরা ভিক্ষা করতে এসেছে নন্দপুরে। মালেক মিয়ার স্ত্রীর নিকট ভিক্ষা নিয়ে মঞ্জুরা মাচায় বসে বিশ্রাম করছে। তার মনটা আজ ভীষণ খারাপ। নয়নধারা থামতে চায় না। কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে সেই ধারা। চোখ মুছতে মুছতে তার শাড়ির আঁচল ভিজে গেছে। মালেক মিয়ার স্ত্রী দূর থেকে তা লক্ষ করে মঞ্জুরার দিকে এগিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে তার বুকে কষ্টের পাহাড় জমে আছে। বাড়িতে কাজের ব্যস্ততা না থাকায় তার মনটা চাইল মঞ্জুরার কষ্টের কথা শুনবে। সম্ভব হলে তাকে একটু সাহায্য করবে। নিকটে গিয়ে সে মঞ্জুরাকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনার শরীর খারাপ? কোন সমস্যা হয়েছে?
-না মা, কোন সমস্যা হয়নি।
-তাহলে কাঁদছেন কেন? আপনাকে এভাবে তো কখনো কাঁদতে দেখিনি।
-মা আমি তো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই কাঁদছি। আমার কান্না তো কেউ দেখা না। আমি বাইরে যা কাঁদি ভিতরে তার চেয়েও বেশি কাঁদি। সেই কাঁন্নার আওয়াজ কেউ শোনে না! কেউ দেখে না!
-কেন? যুদ্ধের সময় কি আপনজনকে হারিয়েছেন? না বড় কোন ক্ষতি হয়েছে?
– ঠিকই বলেছ ধরেছ, মা। আমার অনেক বড় সর্বনাশ হয়েছে! এসব দুঃখের কথা কেউ শুনতে চায় না। কেউ বুঝতে চায় না।
-আপনি আমাকে বলেন। আমি শুনব। কী হয়েছে আপনার?
মঞ্জুরা তার কষ্টের কথাগুলো মালেক মিয়ার স্ত্রীকে বলতে শুরু করে। আমার স্বামী ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে ভারতে গিয়েছিল। আমি তখন আমার সন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। মেয়ের বয়স ছিল পাঁচ বছর। শ্বশুরবাড়ির দুই গ্রাম পরে পাকিস্তানী সৈন্যদের ক্যাম্প ছিল। ওদের সহযোগিতা করত গ্রামের কিছু লোকজন। যারা দেশ স্বাধীনের বিপক্ষে ছিল। সৈন্যদের তুষ্ট করার জন্য নানান ধরণের অপকর্মে লিপ্ত ছিল। তাদের নেতা ছিল গ্রামের একজন মেম্বার। পরে জেনেছি ওরা সকলে রাজাকার ও আলবদরের সদস্য ছিল। ৭১ সালের অক্টোবরের প্রথম দিকে এক মধ্যরাতে রাজাকাররা আমাকে ধরে নিয়ে পাকসৈন্যদের হাতে তুলে দেয়। তারা আমাকে ক্যাম্পে আটকে রাখে। ওই নরপশুরা একটি রাতেও ঘুমাতে দেয়নি। ওদের লালসার শিকার হয়েছি বারবার। বহুবার পালিয়ে আসার চেষ্টা করেছি কিন্তু পালাতে পারিনি। ওরা আমাকে পাহারা দিয়ে রাখত। আমি চিৎকার করে কাঁদতাম। ওরা আমার মুখ বেঁধে রাখত। আত্মীয়-স্বজনরা কেউ জানত না আমি কোথায় ছিলাম। তাদের বিশ্বাস ছিল অপহরণকারীরা আমাকে মেরে ফেলেছে। আমার আর্তনাদে ক্যাম্পের সৈন্যরা অতিষ্ট ছিল। মাসখানিক আটকে রাখার পর ওরা আমাকে ছেড়ে দেয়। ছাড়া পাওয়ার পর ছুটে গিয়েছিলাম শ্বশুর বাড়িতে। খবর পেয়ে আমার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনরা ছুটে আসে শ্বশুরবাড়িতে। আমাকে জীবিত পেয়ে মা-বাবা আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই খুশি হয়েছিল। খুশি হতে পারেনি শুধু শ্বশুরবাড়ির লোকজনরা। ক’দিন পরেই শ্বশুরের অনুরোধে কোলের সন্তানকে নিয়ে মা-বাবার কাছে ফিরে আসি।
এরপর মাস দেড়েক পর দেশ স্বাধীন হলো। আনন্দে স্বাধীন দেশের পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে। সকলের বুকের মধ্যে খুশির বন্যা বইছে। যেসব মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে ছিলেন তারা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করে। তাদেরকে পেয়ে স্বজনরা কিযে খুশি হয়েছিল তা আজও ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার স্বামীও ফিরে আসে। গ্রামে ফিরেই আমাদের বাড়িতে ছুটে আসে। পরেরদিন আমাকে আবার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যায়। একদিন আমার স্বামী জানতে পারে- রাজাকাররা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমার স্বামী বিষয়টি মেনে নিলেও শ্বশুরবাড়ির লোকজনরা কোনভাবেই মেনে নেয়নি। তারা সবসময় আমাকে মানসিক নির্যাতন করত। শুধু ওরা কেন, গ্রামবাসীরাও নানান ধরণের আজেবাজে কথা বলত। অবশেষে আমার স্বামীও আমাকে ভুল বুঝল। আমাকে মেনে নেয়নি। বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমি আবার বাপের বাড়িতে আশ্রয় নিই। ক’দিন পরে জানতে পারি আমার স্বামী আমাকে তালাক দিয়েছে। কিছুদিন পর সে আবার বিয়ে করে সংসার শুরু করে। আমার মেয়ে ছিল ওর বাবার কাছে। আর আমি- দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করে বাপের বাড়ি থেকে গেলাম।
আমার বাবা-মা ছিল খুব গরিব। আমাকে নিয়ে তারা সমস্যায় পড়ে যায়। আমার ইচ্ছা না থাকাই বাবা আমাকে বিয়ে দিতে পারেনি। দুর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় ঢাকাতে চলে আসি। লোকজনের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করি। আমি বড়ই হতভাগা! গৃহকর্মীর কাজ করেও শান্তি পাইনি। পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টি আমাকে সবসময় তাড়া করে বেড়াত। মাঝেমাঝে ব্যর্থ হয়েছি ওদের হিংস্র থাবা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। আমি আমার মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকি। গৃহকর্মীর কাজ ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন দোকান ও ফ্যাক্টরীতে কাজ করেছি। সেখানেও একই সমস্যা। আমার রূপ-সৌন্দর্য আমাকে একদন্ড শান্তি দেয়নি। অবশেষে ঢাকা শহর ছাড়তে বাধ্য হই। ঠিকানা খুঁজে নিই অন্যকোন শহর-গাঁয়ে।
মাঝে মাঝে আমার মেয়ে ও বাবা-মাকে দেখতে গ্রামে যেতাম। আমার মেয়েটা বেশশান্ত ও মিষ্টি স্বভাবের একটা মেয়ে। গ্রামের স্কুলেই পড়ালেখা করে। পড়াশুনাতে বেশ ভাল। সেই প্রিয় সন্তান ও মা-বাবা ছাড়াই আমার জীবন চলতে থাকে। জীবন থেকে কবে যে ১০টা বছর কেটে গিয়েছিল বুঝতে পারিরি। গ্রামে গিয়ে একদিন শুনলাম পাশের গ্রামের এক পরিবারে আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ওর বিয়ের কথা শুনে আমি খুশি হলাম। ওকে দেখার জন্য আমার প্রাণটা পুড়তে থাকে। জানটা আনচান করে। তাই সুযোগ পেলেই ওর কাছে ছুটে যেতাম। একদিন মেয়েকে দেখতে গেলাম ওর শ্বশুরবাড়িতে। আমি বুঝতে পারি- আমার উপস্থিতি কেউ পছন্দ করছে না। মেয়েটাও খুব কষ্ট পায়। দেরি না করে তাড়াতাড়ি বিদায় নিই। বিদায় বেলায় মেয়ে বলে- “মা, তুমি যদি আমার ভাল চাও, তাহলে আর কক্ষনো এখানে আসবে না। উত্তরে বলেছিলাম, তোর কষ্ট হবে এমন কাজ আমি কক্ষনো করব না। ওর আলোকিত জীবনে আমার জীবনের কালিমা স্পর্শ করতে দিইনি। মেয়েকে আশীর্বাদ করে বিদায় নিই। ওটাই ছিল মেয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। কত জায়গাতে ঘুরেছি, কত জায়গায় গিয়েছি মেয়েটার মুখখানা আমি আজও ভুলতে পারিনি। ওর কথা মনে হলে আমার জানটা হু হু করে ওঠে। জানিনা মেয়েটা কেমন আছে। ফৌজদারী পাড়ায় কবে যে এসেছি আজ আমার মনে নেই। শুধু জানি গ্রামের লোকজনারা আমাকে খুব ভালোবাসে। ওই গ্রামের মাটি আমার খুব টানে মা, খুব টানে। গ্রামটা মায়ের মতো মনে হয়। তাই ওখানেই রয়ে গেলাম। ভাবছি বাকি জীবনটা ওখানেই থেকে যাব। পৃথিবীতে আপন বলতে আজ আমার আর কেউ নেই। শুনেছি মা-বাবা অনেক আগেই গত হয়েছে। মেয়েটা হয়ত বেঁচে আছে। কিন্তু তার সাথে দেখা করার অধিকার আমার নেই। আর সেও জানেনা আমি বেঁচে আছি কিনা?
এই স্বাধীনতার মাসে আমার বুকের কষ্টটা অনেক গুণ বেড়ে যায়। অতীতের স্মৃতিগুলো আমাকে বড্ড পীড়া দেয়। দুঃখের স্মৃতিগুলো ভুলে থাকতে চেষ্টা করি। তবু ভুলতে পারি না। জানো মা, হৃদয়ের মাঝে বারবার উদিত হওয়া একটা প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর আজও পাইনি। কোন অপরাধে আমার চোখে এত কাঁন্না? আর এ কাঁন্না কবে থামবে? অবশ্য এর একটা উত্তর আমি পেয়েছি। তাহলো- একমাত্র মৃত্যুই পারে আমার বুকের সকল কাঁন্নাকে থামিয়ে দিতে। সকল কষ্টকে মুছে দিতে। মঞ্জুরার কথা শুনতে শুনতে মালেক মিয়ার স্ত্রীর দু’চোখ ভিজে যায়। দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়া দেখে মঞ্জুরা তার হাত দুটি ধরে বলে, তোমাকে কষ্ট দিলাম নাতো? মাফ করে দিও। কথাগুলো শেষ করেই মঞ্জুরা আবার লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ভিক্ষার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সামনের দিকে। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। মালেক মিয়ার স্ত্রী নিশ্চুপ নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়। মঞ্জুরা দৃষ্টি সীমানার বাইরে যাওয়া পর্যন্ত অপল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।