ভয় না পেয়ে জয় করতে হবে চিন্তার চ্যালেঞ্জ নিতে অনুপ্রাণিত করে ‘গণিত’

43

সুপ্রতিম বড়ুয়া

গণিতবিদ পল এরডোস এর মতে ‘গণিত ছাড়া আর সবকিছুর মৃত্যু অনিবার্য’। অর্থাৎ গণিতকে বলা হয় সকল বিদ্যার রানী। জন ব্যারোর মতে ‘গণিত হল চিন্তার সেই মহত্তম প্রকাশ যা ভৌতজগৎ সম্পর্কে আমাদের ভাবায়, বিস্মিত করে, বোঝায় এবং চিন্তার চ্যালেঞ্জ নিতে অনুপ্রাণিত করে’। সবচেয়ে মূল কথা, গণিত আমাদের যুক্তিসঙ্গত চিন্তার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। গণিতের সাহায্যে আমরা ভৌত বিধিগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে থাকি। প্রকৃতির সকল পর্যবেক্ষণের এক বিরাট Ñ বিপুল ডাটাসেট নির্দেশ করে। এই প্রায়- অসীম ডাটাসেটকে সংক্ষেপে কিছু বিমূর্ত- প্রতীক ও চিত্রের সাহায্যে কিছু যুক্তির- শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলাই গণিতের কাজ। অসংখ্য পর্যবেক্ষণ থেকে সাধারণীকরণের মাধ্যমে বিমূর্ত আইন সৃষ্টিই গণিতের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ গণিত এই কাজের বিশাল সহায়ক।
গণিতের মধ্যে স্বাভাবিক সংখ্যা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা আছে। সেই বাস্তব গবেষণা ইচ্ছে করলে আমরা বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে কোমলমতি শিশুদের মগজে ঢুকিয়ে দিতে পারি। এই স্বাভাবিক সংখ্যা সিরিজ সম্পর্কে বাট্রান্ড রাসেল বলেছেন ‘সভ্যতার অত্যন্ত উচ্চ- স্তরে পৌঁছলে তবেই আমরা আমাদের সকল আলোচনার সূত্রপাত এই সিরিজ থেকে শুরু করতে পারি’। স্বাভাবিক সংখ্যাগুলো আমাদের অবাল্য পরিচিত ও গণনার মতো বস্তুনিষ্ঠ প্রক্রিয়ার সাথে যুুক্ত, এরা যে মানুষের কল্পনার ও চিন্তার ফসল সে কথা আমরা লক্ষ করি না। বাস্তব জগতে তিনটি আম, তিনটি গরু এসবে অস্তিত্ব থাকলেও শুধু মাত্র ‘তিন’ ত্রিভুবনে কোথাও নেই। ‘তিন’ হচ্ছে সেই বিমূর্ত ধারণা, যা তিনটি আম, তিনটি বই তিনটি গরু অথবা তিনটি সদস্যবিশিষ্ট সকল সেটের সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। অসীম আমাদের স্বাভাবিক সংখ্যা। সুন্দর বস্তুনিষ্ঠভাবে এই সব স্বাভাবিক সংখ্যাগুলো শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় বলে মনে হয় না। আজকাল গণিত প্রবলেম সলভিংয়েই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। গণিত যে মানুষের চিন্তার ইতিহাস সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আবিষ্কার সেটা আমরা ভুলেই যাই। এই উৎকৃষ্ট আবিষ্কার প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর কাছে এখন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এককথায় গণিত মানেই তাদের কাছে ভীতি। সেই ভয়কে জয় করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের অগ্রসর হতে হবে।
যেকোন কিছু শেখার আগে বা জয় করার আগে প্রথম শর্ত হচ্ছে সে বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা। কেউ যদি গণিত বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে শিখতে চায় অথবা গণিতের উপর যে ভীতি আছে তাকে জয় করে পারদর্শী হতে চায় তবে প্রথমেই তাকে গণিত বিষয়টাকে অন্য সব বিষয়ের মত স্বাভাবিকভাবে নেওয়া শিখতে হবে। গণিত চর্চা করার সময় অনেক সূত্র মাথায় রাখতে হয় এবং তা মুখস্থ করে রাখতে হয়। এসব মুখস্থ করা ছাড়া বাকি সবকিছু গাণিতিক সমস্যা মাথা ঠাÐা রেখেই বুঝে করা প্রয়োজন। যদি না বুঝে মুখস্থ করা হয় তাহলে দেখা যায় গাণিতিক সমস্যাগুলো সমাধান করার সময় খুব জটিলাকার ধারণ করে। পরীক্ষার প্রশ্নে কোন গাণিতিক সমস্যা একটু ঘুরিয়ে দিলেই শিক্ষার্থীদের পক্ষে তা সমাধান করা কঠিন হয়ে যায়। তাই যতটা সম্ভব যে কোনো গাণিতিক সমস্যা বুঝে করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে গণিত বিষয়টি থেকে ধীরে ধীরে ভীতি কমে যাচ্ছে।
গণিতের প্রতি ভয় সৃষ্টি হওয়ার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে সমস্যা সমাধান করার সময় অনেকেই টাইপ ধরে না করে এক এক সময় এক এক ধরনের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে, যার ফলে সমস্যাগুলো মনে হয় অনেক জটিল। তাই সমস্যা সমাধান করার সময় একই ধরনের সমস্যাগুলো একসাথে করা উচিত। তাহলে দেখা যায় নিয়মগুলো মনে রাখতেও সমস্যা হয় না। আর সেই টাইপের কোন সমস্যাতেই আটকে যাওয়ার একেবারেই সম্ভাবনা থাকে না। আর একটি বিষয় জানা দরকার গণিত এমন একটি বিষয় যার উপর দক্ষতা জিনিসটা নির্ভর করে পুরোপুরি অনুশীলনের উপর। একটি সমস্যা যতবার সমাধান করা যায় সেটির উপর দক্ষ ততই বৃদ্ধি পাবে। এক সময় এসে দেখা যায়, যে কোন টাইপের গাণিতিক সমস্যা যত জটিল করেই আসুক না কেন ঠিকিই তার সমাধান বের করে ফেলা যায়। কোন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে কোন জায়গায় ভুল করলে তা সাথে সাথেই শুধরে নেওয়া দরকার।
ভুলগুলো চিহ্নিত করে ঠিক করে সঠিক জিনিসটা জেনে সমস্যার সমাধার করে নিতে হবে। যাতে পরবর্তীতে এই ধরনের কোন সমস্যা সমাধানে আর বেগ পেতে না হয়। তার ফলে ধীরে ধীরে গণিতের দক্ষতা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে এবং এক সময় দেখা যাবে ভীতি কমার পাশাপাশি ভুল ছাড়াই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। স্কুল কলেজের অনেক শিক্ষার্থীদের দেখা যায় গণিতের নাম শুনলেই একটা ভীতি সৃষ্টি হয়। শুধু স্কুল কলেজ নয় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও এই ভীতিটা প্রকট। কিন্তু গণিত নিয়ে ভয় সবার একরকম নয়। অনেক শিক্ষার্থীদের দেখা যায় তারা গণিতে অসাধারণ পারদর্শী। তাদের যেকোন সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হলে অনায়াসে সেটা নিয়ম মেনে সমাধান করে দিতে পারে। কেউ আবার গাণিতিক সমস্যা সমাধান করাকেই ভয় পায়, কেউ আবার ভয় পায় সমস্যার মাঝখানে এসে আটকে যাওয়া, কেউ আবার ভয় পায় শুধু গণিত পরীক্ষাতে। বর্তমানে যে সব শিক্ষার্থী গণিত নিয়ে পড়াশুনা করছে বা গণিত বিষয়টাকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করার জন্য চিন্তাভাবনা করছে। তারা ইচ্ছে করলে ইন্টারনেট যুগের এই সময়ে ওয়েবসাইটে ঢুকে বাস্তব সম্মত গণিতের প্রয়োগ জেনে নিতে পারে। এই সব ওয়েবসাইটে অতি সহজতর প্রতিটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান বাস্তব চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
যাই হোক শিক্ষার্থীরা চলো সকল বিদ্যার রানী এবং চিন্তার চ্যালেঞ্জ নিতে যে গণিত বিষয় অনুপ্রাণিত করে সেই গণিতকে ভয় না পেয়ে আজ থেকে শুরু করা যাক আমাদের গণিতকে জয় করার মিশন।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক