ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং পুরো জাতির জন্য অশনি সংকেত

39

মুহাম্মদ এনামুল হক মিঠু

করোনার এই ক্রান্তিকালে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব স্তব্ধ, দিশেহারা ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে দ্বিতীয় ঢেউ সামলানো ছাড়াও নতুন অন্য সংক্রমণের আভাসে সবাই বিচলিত। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের অবস্থান খুব বেশি অসহনীয় হয়নি এখনও। আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়ালেও সুস্থতার দৃশ্য অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। থমকে যাওয়া আর্থ-সামাজিক বলয় প্রাসঙ্গিক কার্যক্রমে ইতোমধ্যে সম্পৃক্ত হওয়ার চিত্রে দেশ এখন অনেকটাই শঙ্কামুক্ত। তবে জাতির মেরুদন্ড শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মাঝখানে যে পর্বত প্রমাণ প্রাচীর তৈরি হয়েছে তেমন অবরুদ্ধতার সঙ্কট এখন অবধি কাটানো সম্ভব হয়নি। সেই ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন বছরেও কবে খুলবে তার কোন নিশানা পাওয়া কঠিন। ফলে বিপাকে পড়েছে অসংখ্য খুদে শিক্ষার্থী এবং উদীয়মান কিশোর-তরুণরা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ক্রমাগত দূরত্বে এই উঠতি বয়সের মূল্যবান সময় কিভাবে কাটছে তাও চিন্তার বিষয়। কারণ ইতোমধ্যে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাংয়ের মারাত্মক কিছু তথ্য চিত্র সামাজিক যোগাযোগ আর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিশিষ্টজনেরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আর দিশাহারা পিতামাতা ছাড়াও সচেতন অভিভাবকরাও চিন্তিত। গত ১১ সেপ্টেম্বর নারায়নগঞ্জের বন্দর উপজেলা হতে র‌্যাব-১১ অস্ত্রশস্ত্র ও ইয়াবাসহ পাঁচজন সন্ত্রাসীকে আটক করে। তাঁদের দলে ‘শ্রাবণ’ নামের ১৮ বছরের এক কিশোরী ছিল- যে ছেলেদের ছদ্মবেশেই দলে ছিল। তাঁর এই ছদ্মবেশ শুধু দলনেতাই জানতো। পিস্তল হাতে এই কিশোরীর বিভিন্ন ভঙ্গির ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুবক-কিশোরদের এই সন্ত্রাসী গ্যাং এলাকায় মাদকসেবন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাস্তানি করে বেড়াতো।
নতুন সময়ে সন্তানদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত কোন দুঃসহ যাত্রাপথে আবর্তিত হবে, সেটাও এক চরম অনিশ্চয়তা। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বিগত ৫/৬ বছর ধরে চট্টগ্রাম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাস জগতে নতুন অপরাধ সংস্কৃতির জন্মলাভ করেছে, যার নাম ‘কিশোরগ্যাং’। যারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, মাস্তানি, মোটর সাইকেলের ভীতিকর মহড়া দেয়া, ইয়াবা সেবন ও বিক্রয়, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, দলের মিছিল- মিটিং করা, বড়ভাই বা গডফাদারদের ফাইফরমাশ পালন করা ইত্যাদি অনৈতিক কাজ ও অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। যে বয়সে এই কিশোরদের স্কুল-কলেজে থাকার কথা, সে সময় তাঁরা অপরাধের সাথে যুক্ত হয়েছে। যে বয়সে তাঁদের হাতে বইখাতা থাকার কথা, সে বয়সে তাঁদের হাতে আমরা ইয়াবা দেখছি। যে বয়সে হাতে কলম থাকার কথা সে বয়সে পিস্তল-চাকু শোভা পাচ্ছে। যাহা পুরো জাতি অবশ্যই দুশ্চিন্তায় উদ্ধিগ্ন। কিশোর অপরাধের দুঃসহ চিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা দুনিয়ায়। এই সময়ের প্রজন্ম হরেক রকম সমাজ আর বিধিবহির্ভূত কার্যকলাপে সম্পৃক্তই শুধু নয়, তার চেয়েও বেশি খুন, রাহাজানি এবং ধর্ষণের মতো জঘন্য অপকর্মেরও অংশীদার। স্কুল-কলেজ থেকে আপাতত বিচ্ছিন্ন এসব কিশোর তাদের জীবনের মূল্যবান পর্বকে অতিক্রম করছে এক চরম ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে। করোনার দুঃসময়কে বাদ দিয়েও বলা যায় বয়সটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং দিগি দিক জ্ঞানশূন্য। স্নেহ মমতার নিরবচ্ছিন্ন ছায়ায় নিজেদের তৈরি করা এসব অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে কোন অমৃতের খোঁজে বিপথে পাড়ি দেয় তাও খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। স্কুলে যাওয়ার অনুপস্থিতিতে কিশোররা মা বাবার সরলতার সুযোগ নিয়ে তথাকথিত অন লাইন ক্লাসের নাম দিয়ে ফাঁকে অশ্লীল/ অনৈতিক ছবির প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছে। যাহাতে একটা কিশোরের জীবন বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। মা বাবার লালিত স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বলা সঙ্গত কিশোর অপরাধ অজানা কিংবা নতুন কোন শব্দ নয়। যুগে যুগে কাল থেকে কালান্তরে বয়ঃসন্ধিক্ষণের এমন অনিশ্চিত পর্বটি বিভিন্ন মোহ আর আবেগ দ্বারা আচ্ছন্ন। ন্যায়-অন্যায় বোধের সীমানা অতিক্রম করে যে ভাবাচ্ছন্ন স্বাপ্নিক জগতের হাতছানি, সেখানে প্রয়োজন মায়া-মমতায় সিক্ত বিশুদ্ধ পারিবারিক আবহ। এক সময় সুগৃহিণী মায়েরাই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপহার দিয়েছেন। স্বল্প শিক্ষিত মমতাময়ী মায়েরা কঠোর নজরদারিতে সন্তানের ভবিষ্যত তৈরিতে এক প্রকার পারদর্শীই ছিলেন বলা চলে। তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত বিস্তারের কোন সুযোগ না পেয়েও শুধু লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া ছাড়াও নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্বাচনে আজকের অভিজ্ঞ অভিভাবকরা কখনও ভুল করেননি। তাদেরই কিছু সন্তানের এমনতর অধোগতি কেন, সে উত্তর হয়ত কারই জানা নেই।
অতীতে কিশোর গ্যাং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাদের কুকর্মগুলো চালালেও বর্তমানে এর ব্যাপক বিস্তারে এলাকাভিত্তিক গ্যাং সংঘবদ্ধ হওয়ার চিত্রও সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। মাদকাসক্তি ছাড়াও আরও কিছু সামাজিক অপরাধ তাদের বিভ্রান্ত এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে নিয়ামকের কাজ করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং তথ্যপ্রযুক্তির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অশ্লীল কিছু কুকর্মের ফল হিসেবে কিশোর অপরাধ বেপরোয়া এবং মারাত্মক হয়ে উঠেছে। এমন জঘন্য অপকৌশলকে থামাতে না পারলে অশনি সঙ্কেত পুরো জাতির জন্য। শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়াও বর্তমান সময়ের অনিবার্য দাবি। প্রতিদিনের নিয়মে শৃঙ্খলার জীবনের ব্যত্যয় ঘটানো আরও দীর্ঘ করা উচিত হবে না। আমাদের অভিভাবকদের তাঁদের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কি করে- তা সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকা পিতা-মাতার নৈতিক দায়িত্ব। আমরা আশা করব- রাজনীতিক, সরকার, সমাজ ও পরিবারের সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে কিশোর গ্যাং কালচার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং দেশ ও জাতি আগামী দিনের অপরাধের মারাত্মক হুমকি হতে রক্ষা পাবে। সন্তানের উঠতি বয়সের স্পর্শকাতর সময়গুলো আমলে নিয়ে সতর্কতা, পিতামাতা এবং অভিভাবকের সচেতনতা, দায়বদ্ধতা এবং সাবধান হওয়াও অত্যন্ত জরুরী। এটাই হোক সর্বস্তরের প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাবন্ধিক