ভয়ংকর সময়ের ভ্রান্তির পরিণাম

38

মনসুর নাদিম

কোভিড-১৯। এই নামটা কোত্থেকে এসেছে ? একটি বিদেশি জার্নাল থেকে জানা যায়, করোনা ভাইরাস ডিজিজ ১৯’র সংক্ষিপ্ত নাম হল এই COVID 19. করোনা থেকে ঈঙ আর ভাইরাস থেকে ঠও ডিজিজ থেকে উ. ২০১৯ এ এই রোগ এর আবির্ভাব ঘটে বলে ১৯ লাগানো হয়েছে সাথে। এই কোভিড ১৯ এর দুর্দমনীয় প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্ব লন্ডভন্ড। বিশ্বের বিজ্ঞানীরা নির্ঘুম রজনী পার করছে এই ভয়ানক ব্যধির টিকা/ ভেকসিন আবিস্কারে। চীনের উহান থেকে আবির্ভূত এই মরণ ব্যধি এ পর্যন্ত হাজার হাজার লোকের প্রাণ নিয়েছে।লক্ষ লক্ষ লোক আক্রান্ত হয়েছে। দীর্ঘ ছয় মাসেও বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, কবিরাজ কেউই করোনা’র প্রতিষেধক বানাতে না পারলেও অনেকে দাবি করছেন ৩ মাসের/ ৬ মাসের/১বছরের মধ্যে তারা সফল হবেন। কেউ স্বপ্নে করোনা’র ওষুধ পাওয়ার দাবি করেন তো কেউ সুরাইয়া তারার আগমনে করোনা’র বিদায় ঘন্টা বাজবে বলেছিলেন। কিন্তু সবই ছিল কথার কথা । আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস করতে করতে নিঃশ্বাস যখন আটকে যাচ্ছিল ঠিক তখনি পত্রিকায় দেখলাম একজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর দাবি- আসছে সূর্য গ্রহণে বিদায় নেবে করোনা। ডঃ কে এল সুন্দর কৃষ্ণা নামের চেন্নাইয়ের এই বিজ্ঞাণীর দাবি ২১জুন২০২০ একই সংগে সূর্যের বলয়গ্রাস ও পূর্ণগ্রাস হবে। সেদিনই করোনা পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। ১৫ জুন এর “হিন্দুস্থান টাইমসের” তথ্য মোতাবেক ডঃ কে এল সুন্দর কৃষ্ণা বলেন-করোনা এসেছে মহাকাশ হতে। গত বছর ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীনের উহান শহরে। ২৬ ডিসেম্বর ছিল সূর্য গ্রহণ। এরপর থেকেই এমন একটা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যেতে থাকে। মূলত ওই সূর্য গ্রহণের সময় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটেছিল । তার থেকেই করোনা’র জন্ম বলে এই বিজ্ঞাণীর দাবি। আগামী সূর্য গ্রহণের সংগে একই সাথে সূর্যের বলয়গ্রাস ও পূর্ণগ্রাস হবে। সেদিনই পৃথিবীতে শেষ হবে করোনা’র দাপট। নিজের তত্তে¡র ব্যাখ্যা দিয়ে ডঃ কৃষ্ণা বলেন, ২৬ ডিসেম্বরের সূর্য গ্রহণকালে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে তড়িতাহত কণা গুলোর মধ্যে একটা বড়সড় রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটেছিল। বায়ো-নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশনে করোনা’র নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। এই স্তর টিকে বলা হয় ‘ডি-লেভেল’। তবে কীভাবে ডি-লেভেলে ভাইরাস তৈরি হতে পারে তার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না বিজ্ঞাণীরা।
তাই এখন আর কিছুতেই বিশ্বাস নেই আল্লাহ ব্যতীত। করোনা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে আল্লাহর ইচ্ছায় ফিরে যাবে।
৭১’র পর থেকে এরকম ভয়ংকর সময় আর আসেনি। ঘর থেকে বের হলে ফিরে আসবে কিনা সন্দেহ ছিল। পদে পদে ছিল মৃত্যুর ভয়। হাতের তালুতে প্রাণ নিয়ে নিরুপায় মানুষ ছুটে চলতো জীবিকার অন্বেষণে। কেউ ফিরে আসত, কেউ হারিয়ে যেত সংকটের মেঘের আড়ালে। প্রতিদিন নীরব আর্তনাদ, বোবাকান্নায় থমকে থমকে জীবনের ভেলা ভেসে চলত উদ্বেগের নীল দরিয়ায়। প্রতিটি মূহুর্তে মৃত্যুর ভয়। ধর্ষিত হওয়ার ভয়। নির্ঘুম রজনী শেষে আতংকের চাদরে মোড়া ছিল দীর্ঘ নয় মাসের এই দিনগুলি । সে এক বিভীষিকাময় দিনের কথা মনে হলে আজও হৃদয়ের পাটাতনে ভারী একটা প্রকাÐ রক্তাক্ত পাথরের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত ওজন অনুভূত হয়।
এখন করোনা কাল। ৭১’র চেয়ে কম ভয়ংকর নয়। এটাতেও মানুষ কবে কোথায় লুটে পড়ে বিশ্বাস নেই। অনেক করোনা রোগীর লক্ষন প্রকাশ পাচ্ছেনা। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া রোবটের মত ধপাস করে লুটিয়ে পড়ে। তখন অনেকে বলে থাকেন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থা লেজেগোবরে। প্রতিদিন শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। আহাজারি করছেন একটি আইসিউ বেডের জন্য। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে রোগীদের জীবন বাঁচাতে হলে ভেন্টিলেটর নয়, হাই ফ্লো নেজাল অক্সিজেন ক্যানুলা সবচেয়ে বেশি জরুরি। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে অক্সিজেনের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে রোগী। শুধু করোনা রোগীই নয়, প্রয়োজনীয় অক্সিজেন না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন অন্যান্য রোগীরাও। চলমান এই অক্সিজেন সংকটকে কাজে লাগিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডারকে মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেন বলে বিক্রি করছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আরেকদিকে পারফিউম ব্যবসার আড়ালে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী কোন প্রকার নিয়ম নীতি না মেনে ইচ্ছেমত বিক্রি করছে পানির বোতলে নকল স্যানিটাইজেসান। নগরীর খাতুনগঞ্জ, পাথরঘাটা আনসার ক্লাব, বান্ডেল রোডে কিছু দোকানে গেলে দেখা যাবে ড্রাম ভর্তি করে রাখা সারি সারি নকল হেক্সিসল ও এন্টিসেপ্টিক যেগুলো ডেটল, সেভলন নাম দিয়ে পেপসি/ ফানটা ও পানির বোতলে ভরে কেজি দরে বিক্রি করছে। চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে নিয়েছেন বলে জেনেছি। উন্নয়ন যে হয়নি তা বলা যাবে না। তবে ঈঙঠওউ-১৯ যে আসবে তা বিশ্বের কোন বিজ্ঞানী জানতেন না। নার্গিস, আইলা,আম্পান ও নিঃসর্গ’রা এলে আবহাওয়া অফিস আগাম সতর্ক বার্তা দেয়। কিন্তু ঈঙঠওউ-১৯’র ব্যাপারে কোন সতর্ক বার্তা ছিলনা। তাই কোন প্রস্তুতিও ছিলনা। এমনিতেই বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এত ভয়ঙ্কর যে, মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত সামান্য অসুখেই ভারতের চেন্নাই/মাদ্রাজ/ভেল্যুর ও কোলকাতা ছুটে যায়। কিছুদিন আগে জনৈক শিল্পপতি সাবেক মন্ত্রী চার্টার বিমানে করে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন। চিকিৎসার এই অব্যবস্থাপনার অজুহাতে অনেকে এটাকে রাজনৈতিক হয়রানি বা মামলা/হামলা থেকে পালিয়ে বাঁচার রক্ষাকবচ বানিয়েছে বললে কী ভুল বলা হবে ? অনেকে মামলা এড়াতে চিকিৎসার নামে বছরের পর বছর পালিয়ে আছে। যদি দেশে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকত তবে চিকিৎসার নামে বিদেশে কেউ পালাতে পারতেন না। কোভিড-১৯ গোটা জাতিকে হেলিয়ে দিয়েছে। এখন অনেক কনভেনশন হলকে আইসোলেশন সেন্টার বানিয়ে সেখানে করোনা’র চিকিৎসা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় করোনা চিকিৎসায় ছোট ছোট হাসপাতাল উদ্বোধন হচ্ছে। এই বোধ যদি আগে জাগ্রত হতো তবে এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হতোনা। আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি, সাধারণ ছুটি বলে ঘোষণা করা সময়টাকে অন্তত একমাস ‘কারফিউ’ ঘোষণা করে দিলে অবস্থার এত অবনতি কখনোই হতোনা। এলাকা ভিত্তিক লকডাউন কোন সুফল বয়ে আনবেনা। করোনা সংকটের উর্ধ্বমুখী সংক্রমনের এই পরিস্থিতিতে অন্তত কাজে দেবেনা বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত ব্যক্তির সংখ্যা লাখের কাছাকাছি চলে গেছে। এই অবস্থায় যে কোন ধরণের লকডাউন কঠোর ভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাওয়ার আশংকা করছেন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ গণ। বাঙালি লকডাউন/সাধারণ ছুটি’র মত শব্দ গুলির সাথে পরিচিত নয়। বাঙালি ১৪৪ ধারা ও কারফিউ/ ধর্মঘটের সাথে পরিচিত। তাই আমরা সাধারণ ছুটিটাকে ঈদের ছুটি বানিয়ে দলে দলে রাস্তায় উল্লাস করে গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। কেউ বিদেশ থেকে এসেই হোম কোয়ারেন্টাইনে না থেকে শ্বশুরবাড়ি, নানার বাড়িতে ছুটিয়ে দাওয়াত খেয়েছে। এরা দেশে-বিদেশে ঘুরে এসেও সচেতন হতে পারেন নি। ফলে বাংলার আকাশে-বাতাসে ইচ্ছামত করোনা উড়ায়েছে যার পরিণতি এখন ভোগ করছে গোটা জাতি।সচেতন ছিলেন না আমাদের রাজনীতিবিদেরাও। এই ভয়ঙ্কর রোগটার ভয়াবহতা আঁচ করতে না পেরে জনৈক রাজনীতিবিদ বলেছিলেন-‘করোনা’র চেয়ে আমরা বেশি শক্তিশালী’। ফলে করোনা সম্পর্কে জনগণের কাছে ভুল ম্যাসেজ গিয়েছে বলে আমি মনে করি। দেরিতে হলেও কেউ কেউ ব্যপারটা বুঝতে পেরেছেন বলে খানিকটা স্বস্তি। গত সপ্তাহে সিটি কর্পোরেশন এর আইসোলেশন সেন্টার উদ্বোধন কালে তথ্যমন্ত্রী স্বীকার করলেন পৌনে এককোটি মানুষের শহরে করোনা চিকিৎসায় সংকট আছে। তিনি আরও বলেন-করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হবার আগে যেভাবে আমরা চলতাম, সেভাবে আর নয়। সেভাবে চললে আমাদের পক্ষে হাসপাতাল প্রস্তুত রেখেও আরও আইসোলেশন সেন্টার বানিয়েও করোনা ভাইরাসের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে আমার সুরক্ষা আমার হাতে (দৈনিক পুর্বদেশ)। ধন্যবাদ মাননীয় মন্ত্রীকে। এই কথা গুলি সরকারি ভাবে আগে বলা খুবই দরকারি ছিল। এখন ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে।
আজ প্রয়োজন বলছে চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার থেকে আন্তর্জাতিক মানের একটা হাসপাতালের খুবই দরকার ছিল।বিশেষ করে হালিশহর বন্দর পতেঙ্গা এলাকায় ইপিজেড, কেপিজেড এর মতো বৃহত্তর শিল্প এলাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের সরকারি হাসপাতাল আজ সময়ের দাবি।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক