ভৌগোলিক কারণেই দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি বেশি

49

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভারতের কয়েকটি রাজ্য এবং নেপালেও বজ্রপাত হয়। তবে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা অনেক বেশি। একইভাবে দেশের আয়তনের তুলনায় বজ্রপাতজনিত হতাহতের সংখ্যাও অনেক বেশি। ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা বা নেপালে বজ্রপাত হলেও সেখানে প্রাণহানির হার এত বেশি নয়। এ জন্য সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বজ্রপাত নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম এওয়ারনেস ফোরাম বলছে, চলতি বছরের মে ও জুন মাসে বজ্রপাতে সারাদেশে মারা গেছেন একশ’ ২৬ জন। আহত হয়েছেন ৫৩ জন। নিহতদের মধ্যে ২১ জন নারী, সাতজন শিশু এবং ৯৮ জনই পুরুষ। এর মধ্যে মে মাসে মারা গেছেন ৬০ জন এবং জুনে ৬৬ জন। মে মাসে নারী ৯ জন, শিশু তিন জন এবং ৪৮ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন। একই সঙ্গে মে মাসে আহত হয়েছেন ২৮ জন। জুন মাসে মোট নিহত হয়েছেন ৬৬ জন। এর মধ্যে নারী ১২ জন, শিশু চারজন এবং ৫০ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন। এছাড়া জুন মাসে বজ্রাঘাতে মোট ২৫ জন আহত হয়েছেন। সর্বশেষ শরতের প্রথম পক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের পাঁচ জেলায় নয়জনের মৃত্যু ঘটেছে। তবে চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ জনপদে বজ্রপাতের খবর মিললেও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, সরকার জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে অন্তর্ভূক্ত করে। ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে তিন হাজার বজ্রপাত হয়। আর জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে আড়াই হাজার বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ পূর্বদেশকে বলেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা তুলনামূলক বেশি হওয়ার মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই রয়েছে হিমালয়, যেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুই ধরণের বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাত-প্রবণ এলাকাগুলোর অন্যতম। গ্রীষ্মকালে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেসব এলাকায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, সেসব এলাকায় যে মেঘের সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই বজ্রপাত বেশি হয়।
জানা গেছে, বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দিতে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে দেশের আটটি স্থানে ‘লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর’ স্থাপন করা হয়। বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ এসব রাডার ঢাকা, চট্টগ্রা, পঞ্চগড়, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা এবং পটুয়াখালীতে স্থাপন করা হয়। কারিগরি দক্ষতার অভাবে রাডারগুলো কোনও কাজে আসছে না।
এ বিষয়ে রাডার বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম জানান, বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া এবং রাডার পরিচালনা বা তথ্য সংগ্রহের দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল আবহাওয়া অধিদপ্তরে নেই। ফলে, রাডারগুলোকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের রাডার কোম্পানি প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন তাদের এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অযত্ন-অবহেলায় রাডারগুলো নষ্ট হচ্ছে। রাডার স্থাপনের আগে বলা হয়েছিল, বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই তথ্য জানা যাবে। মোবাইল ফোনে ১৫ মিনিট আগেই ওই এলাকার মানুষকে বজ্রপাতের তথ্য জানিয়ে দেয়া যাবে। ভারতের উড়িষ্যায় এ প্রযুক্তিতে প্রাণহানির সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
বজ্রপাতের সময় করণীয় :
সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম এওয়ারনেস ফোরামের জানিয়েছে, যে স্থান বা বস্ত যত উঁচু সে স্থান মেঘের তত সন্নিকটে থাকায় সেখানে বজ্রপাতের সম্ভাবনা তত বেশি হয়। তাই বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচুস্থানে অবস্থান করলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে।
ঘন কালো মেঘ বা ঝড়ো মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে এবং বৃষ্টি শুরুর আগে নিরাপদস্থানে আশ্রয় নিতে হবে। পাকাবাড়িতে আশ্রয় নেয়া বেশি নিরাপদ। তবে পাকা বাড়ি সুউচ্চ হলে সে ক্ষেত্রে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় জানালার কাছে না থাকাই ভালো। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল থাকা এবং পানি ও যে কোনও ধাতব বস্তু যেমন সিঁড়ি বা বারান্দার রেলিং, পানির কল ইত্যাদির স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। বিদ্যুৎ পরিবাহী যে কোনও বস্তুর স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। পুকুর বা জলাশয়ে থাকা নিরাপদ নয়। বাড়ির বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রের বিদ্যুৎ ও ডিসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা ভালো। এগুলো বন্ধ থাকলেও স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। মাঠের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় থাকলে বজ্রপাতের সময় কানে আঙ্গুল দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিচু হয়ে বসে থাকতে হবে। তবে মাটিতে শোয়া যাবে না, কেননা মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বজ্রপাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে গাড়ির মধ্যে থাকা নিরাপদ। তবে গাড়ির ধাতব কোনও অংশের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে।