ভোরের শিশিরস্নাত এক জীবনকাব্যের নাম

55

একজন মানুষের আয়ু কতদিন ক’কদম তা একমাত্র আল্লাহ গফুরুর রহিম ছাড়া কেউ জানে না – জানার কথা নয়। তবে মুরব্বিদের বলতে শুনেছি “ভালো মানুষ বেশিদিন হায়াত পায় না”। হয়তো তাই, বাংলাদেশের অন্যতম প্রিয় শিশুসাহিত্যিক, কবি ও কথাশিল্পী রমজান আলী মামুনের অকাল মৃত্যু আমাদের কাছে সেই আপ্ত বাক্যটি নতুন করে নাড়া দিয়েছে। মাত্র একান্নটি (জন্ম: ৩ আগস্ট ১৯৬৮, মৃত্যু ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯) বসন্ত পেরোনো এই চিরসবুজ কবি নিজে কাঁদলেন না। অন্যকে কাঁদালেন অঝোরে- বুক চাপড়ে। কাঁদালেন চট্টগ্রামের সকল শিশুসাহিত্যিককে, কাঁদালেন বদরপাতির সকল মানুষকে। অনেকে কাঁদলেন না কিন্তু হয়ে গেলেন বিখ্যাত ইংরেজি কবিতা “ঃযব ড়িসধহ রিঃযড়ঁঃ ঃবধৎং” এর মতো বোবা, পাথর।
গত দু’বছর ধরে তিনি প্রায় বলতেন, ‘এমরান দা’ আজ মরলে কাল দু’দিন। এ কথার মাধ্যমে তিনি আমাদের তাঁর প্রস্থানের বার্তা দিয়েছিলেন কি না জানি না। আজ মনে হচ্ছে তিনি হয়তো তাই দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর বিভিন্ন লেখায় ভোরের শিশিরস্নাত জীবনকাব্যের কথা আকারে ইঙ্গিতে বার বার এসেছে। বছর দুয়েক আগে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর “সুখে দুখে ফেসবুকে” কলাম লিখেছিলেন, “ আমরা সবাই ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি”। একটা সময় মানুষকে মৃত্যুভীতি পেয়ে বসে। মামুন মৃত্যুের চিন্তা করতেন, যা একজন মুসলমান হিসেবে সবারই করা উচিত। তিনিও তাই করেছেন কিন্তু এত তাড়াতাড়ি! ভাবতেই বুক ফেটে যায়।


তাঁর প্রকাশিত একটি কাব্যগ্রন্হের নাম— আমার অনেক কষ্ট আছে। এটি প্রকাশিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ । বইটার বেশ কাটতি হয়েছিল। টগবগে এক তরুণ, তার ওপর রাজপুত্রের মতো চেহারার মানুষটার ভেতরে কোনো কষ্ট থাকতে পারে কখনো সিরিয়াসলি ভাবিনি। কী কষ্ট ছিল তাঁর বুকে? হয়তো না পাওয়ার বেদনা, পেয়েও হারানোর বেদনা! তাঁর সেই কষ্ট কার জন্য তার জবাব এসেছিল একুশ বছর পর তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হে “ তোর জন্য কষ্ট আমার”। আর সেই অসীম কষ্টের, চাপা কান্নার শব্দমালার ভূমিকা লিখতে হয়েছিল আমাকে। এটি ছিল আমার জন্যে আরেক কষ্টের। রমজান আলী মামুনের শিশুদের জন্য লেখা গ্রন্হের সংখ্যা বারোটি। দুটি কাব্যগ্রন্হসহ মোট প্রকাশিত গ্রন্হ চৌদ্দ। তাঁর প্রকাশিত প্রথম গ্রন্হের নাম হারিয়ে যাওয়া দুপুরে (১৯৯১)। কিশোর গল্পের এই গ্রন্হটি প্রকাশ করেছিলেন ছড়াশিল্পী মাহবুবুল হাসান। তাঁর অন্য ৫টি কিশোর গল্পগ্রন্হের নাম হলো: আকাশপরী ও পাপিয়া, এক যে ছিল রাজকন্যাে, দিবা ও রহস্যময় বুড়ো, কিশোর নেমেছে যুদ্ধে, খুকি ও রবীন্দ্রনাথ (২০১৯), ২টি কিশোর উপন্যাস হলো : রেল ছোটে মন ছোটে (২০১৬), মিঠু তুমি স্বাধীনতা (২০১৯)। ৩টি কিশোর কবিতাগ্রন্হ : নীল ডানা এক পাখি (১৯৯১), সবুজাভ কোন গ্রামে (২০১৬), আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ (২০১৮) এবং একমাত্র ছড়াগ্রন্হ: ছড়ার গাড়ি থামবে বাড়ি (২০১৪)। সাড়ে তিন দশক ধরে লেখালেখিতে সম্পৃক্ত থেকে তিনি পেয়েছেন মনন সাহিত্য সম্মাননা (২০১২), বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি কিশোর কবিতা সম্মাননা (২০১৬), বঙ্গবন্ধু একাডেমি কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সম্মাননা (২০১৮), অক্ষরবৃত্ত শিশুসাহিত্য পাÐুলিপি পুরস্কার (২০১৮)। সবশেষে মৃত্যুর ৪৮ ঘণ্টা আগে গ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি পদক (২০১৯)। রমজান আলী মামুন শুধু একজন সুলেখকই নন, ছিলেন একজন তুখোড় সংগঠক। তিনি মাসিক শিশু সাহিত্য পত্রিকা ‘কথন’ এর নির্বাহী সম্পাদক, সাহিত্য সংগঠন ‘স্বকাল’ এর অন্যতম পরিচালক, শিশু কিশোর সাময়িকী ‘আলোর পাতার’ সম্পাদনা পর্ষদ সদস্য, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঐতিহ্য সাংস্কৃতিক ফোরাম’ এর সিনিয়র সহ সভাপতি, টেরিবাজারস্থ বদরপুকুর উত্তরপাড় সামাজিক সংগঠন ‘যুবকণ্ঠের’ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। চট্টগ্রাম একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু সাহিত্য একাডেমির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। প্রথম জাতীয় ছড়া উৎসবে তিনি রাখেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। মামুনের জীবনে পুরস্কার কোনো বড় বিষয় ছিল না। সাহিত্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের কাছে তিনি যে অপরিসীম ভালোবাসা পেয়েছেন সেটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
মামুনের লেখালেখির সূচনা হয় চিঠিপত্র কলামের মাধ্যমে। তাঁর লেখালেখির শুরুর দিক নিয়ে তাঁর একান্ত কাছের বন্ধু কবি ও শিশুসাহিত্যিক সাঈদুল আরেফীনের একটি লেখা থেকে জানতে পারি মামুন ক্লাস সিক্স/ সেভেনে পড়ার সময় থেকেই চিঠিপত্র কলামে তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপট ও উন্নয়ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত লিখতেন। এস.এস.সি পাস করার পর সাহিত্যের নান্দনিক ভুবনে অভিষেক ঘটে তাঁর। স্কুলের পর তাঁর অবসর সময়টা কাটত পাবলিক লাইব্রেরির বইয়ের ভুবনে ডুব দিয়ে। তাঁর বাড়ি থেকে পাবলিক লাইব্রেরি ছিল কয়েক মিনিটের পথ। ফলে সুযোগ পেলেই তিনি ঢু মারতেন লাইব্রেরিতে। এভাবে তাঁর পড়া হয়ে যায় বাংলা সাহিত্যের সেরা বইগুলো।
চট্টগ্রামের অন্যতম প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আবির প্রকাশনে ছিল তাঁর নিয়মিত আড্ডা। আবির প্রকাশনের কর্ণধারের সঙ্গে ছিল তাঁর গলায় গলায় ভাব। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, দিন-রাত্রির অনেক গল্পই বলতেন তিনি। সেই প্রকাশনে বসে এক আড্ডায় মামুন বলেছিলেন, “আমার জন্য চিকিৎসা সহায়তা তহবিল” গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা যদি আমার পরিবারের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন সেটাই হবে সর্বোত্তম সহায়তা। কথাটা তিনি বলেছিলেন হাসিরছলে কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল তাঁর অবর্তমানে তাঁর পরিবারের আর্থিক অনিশ্চয়তা। মামুন সব কথাই যেন বলে গেলেন। কাউকে এতটুকু কষ্ট দিলেন না, না পরিবারকে, না বন্ধু মহলকে।
রমজান আলী মামুন ছিলেন আমার অনুজের মতো। যখন যা বলেছি তা করে গেছেন কোনো রকম টু শব্দটি ছাড়া। কখনো কোনো কথার ব্যাখা চাননি। এ এক অদ্ভুত মানুষ। অন্যকে সন্তুষ্ট করতেই যেন তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁদের বাড়িতে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল বিশেষ করে তাঁর লেখালেখি জীবনের প্রথম দশ বছর। তাঁর মায়ের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িত। তাঁর মায়ের একটি কথা আমার এখনো মনে পড়ে। মামুনের মা একদিন আমাকে বললেন, “তোরা (লেখকেরা) আমার ছেলেটাকে নষ্ট করে দিলে! সারাদিন কি ছাইপাশ লিখে বুঝি না।” মা-বাবাদের ধারণা লেখালেখি বাজে একটা জিনিস। মামুনের মায়েরও ওরকম একটা ধারণা ছিল। আজ তাঁর মা বেঁচে থাকলে নিশ্চিত তিনি গর্বভরে বলতেন, আমার ছেলে একজন সত্যিকারের মানুষ হয়েছে। না হলে এত মানুষ তাঁর ছেলেকে ভালোবাসে কেন? মামুনের মৃত্যুর পর জানাজায় মানুষের ঢল দেখে বুক ভরা কষ্ট নিয়েও নিশ্চিত তিনি এ কথাটি বলতেন। মামুন বিত্তের সাধনা না করে চিত্তের আরাধনা করেছেন, আর তাতে তিনি জয়ী হয়েছেন, চিরজীবনের জন্য।
রমজান আলী মামুন বড় অভিমানী ছিলেন। তবে সেই অভিমান কখনো প্রকাশ করতেন না। তাঁর পরম ধৈর্য্য শক্তি ছিল। যে শক্তির বলে শত টানাপোড়েনের মধ্যেও চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন সুকুমার শিল্পের চর্চা। চট্টগ্রাম শহরে যেখানটায় তাঁর জন্ম সেখান থেকে উঠে আসার কথা ছিল একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী। কিন্তু মামুন টাকার পেছনে না ছুটে, ছুটেছেন সত্যের পেছনে, সুন্দরের পেছনে। ফলে তাঁর কোনো ব্যাংক হিসাব নেই, কখনো ছিল না। তিনি গৃহী হয়েও সন্নাসীর মতো জীবনযাপন করে গেছেন। তাঁর জীবনটা এত সাধারণ ছিল যে খুব অল্পে তিনি তুষ্ট থাকতেন। চায়ের দোকানে ঢুকলে এক কাপ চা দু’জনে ভাগ করে খেতেন। কখনো দামি খাবারের প্রতি তাঁর এতটুকু লোভ ছিল না। যেমনটা এসেছিলেন পৃথিবীতে ঠিক তেমন করেই বিদায় নিলেন বিজয়ীর বেশে। মামুন যে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তা আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তাঁর লেখালেখির সাড়ে তিন দশক পূর্তি অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে নিয়ে। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, বাধ সাধল ম্যাগাজিন। স্বল্প সময়ে ম্যাগাজিনের কাজ শেষ করা মোটের ওপর অসম্ভব ছিল। ফলে প্রোগ্রামটা পিছিয়ে দেওয়া হয়। জানি না তাঁর এ অপূর্ণ সাধ আমরা পূরণ করতে পারব কি না? পরম করুণাময় আল্লাহ একমাত্র সহায়।
একটি মানুষ হারিয়ে গেলে কার কি ক্ষতি হয়?
তোমার না হয়
আমার না হয়
হয়তো কারো হয়!
কবি রমজান আলী মামুন জ্ঞাতসারে হোক অজ্ঞাতসারে হোক জীবনের নিরেট বাস্তবতার কথাটি বলে গেছেন তাঁর কবিতায় অত্যন্ত সাবলীলভাবে। সত্যিই তো একজন মানুষের বিদায়ে সবার ক্ষতি হয় না। হয় কারো না কারো। সে ক্ষতি কখনো পূরণ হবার নয়- হয় না। এই যেমন ক্ষতি হলো আমাদের, শিল্প ও সুন্দরের। আজ নিজেদের বড় অপরাধী মনে হচ্ছে, চোখের সামনে তরতাজা মানুষটি চলে গেল। আমরা জানতেই পারলাম না সত্যই তাঁর কী হয়েছিল? ভাই ক্ষমা করো এ অধমদের । আমরা আপনার কোনো কাজেই আসতে পারিনি । তবে আমরা নিশ্চিত আল্লাহ পাক আপনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করবেন। কারণ আপনি শুধু কবি, শিশুসাহিত্যিক ছিলেন না। ছিলেন আপাদমস্তক একজন মানবিক মানুষ। ভালো মানুষ। ভালো মানুষের স্থান নিঃসন্দেহে জান্নাতুল ফেরদৌসে। আল্লাহপাক আপনাকে সেই স্থান নসিব করুন।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক