ভোগ্যপণ্যের আড়ালে তামাকের প্রচারণা

110

পানির অপর নাম জীবন। শুধু জীবন কেন, সভ্যতাও গড়ে উঠেছে এই পানিকে ঘিরে। আর সেই জীবনদানকারী পানির সাথে সিগারেটের মূল্যস্তরের তুলনা রেখে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘অপপ্রচারে’ নেমেছে তামাক কোম্পানিগুলো। পানি ছাড়াও চা, চকলেটের সাথেও সিগারেটের মূল্য তুলনা করা হয়েছে বিজ্ঞাপনে। এখানেই শেষ নয়, বীরের সাথেও সিগারেটের তুলনা করেছে কোম্পানিগুলো।
করোনা সংকটের এ সময়ে প্রতিটি এলাকায় সিগারেট কোম্পানিগুলোর এমন উদ্ভট প্রচারণার মাধ্যমে কোমলমতি শিশু ও তরুণদের তামাকের প্রতি আকর্ষণ করা হচ্ছে। যদিও আইন অনুযায়ী তামাকের বিজ্ঞাপন ও প্রকাশ্যে বিক্রি নিষিদ্ধ।
একটি পানির বোতলের দাম ১৫ টাকা, এক কাপ চা ৬ টাকা আর ডার্বি স্টাইল ৪ টাকা। এমন লিখা সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপন এখন দোকানে দোকানে। একইভাবে শেখ স্মুথ প্রতি শলাকা ৪ টাকা, পানির দাম ১৫টাকা, প্রতিপিস চকলেট ২ টাকা। শেক ও ডার্বি সিগারেটের এমন বিজ্ঞাপন নগর ছাড়াও গ্রাম গঞ্জের প্রায় এলাকায় লাগানো হয়েছে। পানি, চকলেট বা চায়ের দামের সাথে সিগারেটের দামের তুলনার এই চিত্রটি দেখে শিশু ও তরুণদের তামাক গ্রহণে উৎসাহী হবে। বিজ্ঞাপন চিত্রটির উপস্থাপনে মনে হতে পারে পানি, চকলেট বা চায়ের থেকে সিগারেট ভালো!
শুধু তাই নয়, আরেকটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, অপেক্ষায় থাকুন, আসছি বীরের বেশে। বিজ্ঞাপনটিতে প্রকারন্তে তামাক গ্রহণকারীদের বীরের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
তামাক বিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, আমাদের দেশে আইনের শাসনের বড় অভাব রয়েছে। যতদিন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না, ততদিন এ ধরনের আইন বিরোধী কার্যক্রমও শেষ হবে না। তামাক কোম্পানিগুলো মানুষ মারার মিশনে নেমেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সাথে তামাকের তুলনার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে তামাকের প্রতি উৎসাহিত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, তামাক বিরোধী আইন অনুযায়ী তামাকের প্রচারণা, বিজ্ঞাপন এমনকি প্রকাশ্যে বিক্রয় ও পাবলিক স্পেসে ধুমপান নিষিদ্ধ রয়েছে। এরপরও তামাক কোম্পানিগুলো নানাভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার অব্যাহত রেখেছে। তামাক বিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রম থাকলেও তামাক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী মনোভাবের কারণে কার্যকর কোনো ফলাফল তেমন আসছে না। জেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ বিভাগ এই প্রয়োগে তাদের আগ্রহ কম। সে কারণে আইনের বিধানগুলি “কাজীর গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নাই” সেরকম আইন প্রয়োগ যথাযথ না হবার কারণে এ ধরনের অপরাধগুলি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক কোম্পানিগুলোর এমন প্রচারণা তরুণদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সাথে তামাকের তুলনা করা জগণ্যতম কাজ। কোনো কারণে তামাক কোম্পানিগুলো তরুণ প্রজন্মকে এমন প্রলোভনে জিম্মি করতে পারলে দেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে। তামাক বর্জন করে তামাক কোম্পানির এই অপচেষ্টা রুখে দাঁড়াতে হবে। নয়তো আগামীর জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জে পরিণত হবে।
দীর্ঘদিন ধরে তামাক বিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল অ্যাকশন (ইপসা)। সংগঠনটির উপপরিচালক (সামাজিক উন্নয়ন বিভাগ) নাসিম বানু শ্যামলী বলেন, প্রতিবছর টেক্স আরোপ করার পর তামাক কোম্পানিগুলো এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করে। তারা তামাকের দাম বাড়েনি এটা বুঝাতে একেক বছর একেক ধরনের করে বিজ্ঞাপনে নামে। এটা আইনের লঙ্ঘন। আইনগতভাবে তামাক কোম্পানিগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে না। এটা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমেও তামাক কোম্পানিগুলো তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিজ্ঞাপনের একটা বড় প্রভাব থাকে। তামাক কোম্পানিগুলো এসব বিজ্ঞাপনে তরুণ ও নতুন ধূমপায়ী ধরার চেষ্ঠা করে। যারা আগে থেকে তামাক গ্রহণ করে তারা তো আছেই, নতুনদের টার্গেট করেই তারা এমন প্রচারণা নামে।
একই প্রসঙ্গে আরেক তামাক বিরোধী সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টস (বিটা)। তামাক পণ্যের এমন বিজ্ঞাপনের বিষয়ে কথা হলে বিটার তামাক প্রকল্পের সমন্বয়কারী প্রদীপ আচার্য বলেন, আমরা সকলে জানি, পানির অপর নাম জীবন। অন্যদিকে আমরা সকলেই জানি, তামাক ক্যান্সারের কারণ। আর জীবনদানকারী সেই পানির সাথে সিগারেটের দামের তুলনা করে নীরবে কোন বিষয়কে উস্কে দিচ্ছে তামাক কোম্পানি? এই কি তবে কোমলমতিদের টার্গেট করে করে তাদের নয়া ফাঁদ! মনে হচ্ছে তরুণ আর কোমলমতি শিশুদের মনোজগতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই কি এমন মিথ্যে অপপ্রচারে নেমেছে তামাক কোম্পানিগুলো। পানি, চা, চকলেট চেয়ে সিগারেটের মূল্যকে কম দেখিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে তরুণ প্রজন্মকে ধাবিত করছে।
তিনি বলেন, বিজ্ঞাপনগুলোতে সিগারেটকে তুলনা করা হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যরূপে। অর্থাৎ তাদের বিজ্ঞাপনী কৌশলে এটা প্রমাণিত যে, তামাককে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে পরিচিত করতেই এমন বিজ্ঞাপন বাজারে ছেড়েছে তামাক কোম্পানি।
বলা হচ্ছে, নিত্যপণ্যের সাথে তুলনা করে প্রচারণার মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো ২০০৫ সালে প্রণীত তামাক আইনের ৫নং ধারাকে লঙ্ঘন করেছে। যা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এই ধারায় বলা আছে, ‘কোন কোম্পানি সরাসরি তামাকের বিজ্ঞাপন প্রচার, প্রচারণা, পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারবে না। কোন ব্যক্তি এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরনের অপরাধ সংঘটন করিলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দন্ডের দ্বিগুণ হারে দন্ডনীয় হইবেন।’