ভূত বৈদ্য চিচিং ফাঁক

114

স্কুল থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম। দুপুরবেলা। পথের ধারে গাবগাছটির তলে আসতেই গা ছমছম করে উঠল। দেখি, গাছ থেকে লম্বা হয়ে একটি পা নেমে আসছে আমার নাক বরাবর। কালো লোমে ঢাকা আঁকাবাঁকা পা। পায়ের বুড়ো আঙুলে ছোট একটি মুখ। চামচিকার মুখের মতন। সেই মুখে আমার নাম ধরে ডাক দিল। পেছনে ফিরে তাকালাম। দেখি পায়ের মুখ থেকে আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে! আমি একনজর দেখেই কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেলাম মাটিতে।
ব্যাপার কী? ছেলেটা এভাবে পড়ে গেল কেন? এসব বলতে বলতে আশপাশ থেকে ছুটে এলো অনেক লোক।
আমি কোনোমতে দাঁড়িয়ে বললাম, একটু জায়গা দেন, আমি বাড়ি যাব।
বাড়ি যাবে মানে? লোকগুলো কপালে চোখ তুলে বলল, বৈদ্যের জন্য লোক পাঠিয়ে দিয়েছি। তুমি কাঁপুনি দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলা, এখনও টের পাওনি তোমার কী হয়েছে? তোমার সঙ্গে এখনও ভূতটা আছে। চুপ করে এখানে বোসো।
একজন বলল, এই যে বৈদ্য এসে গেছে। এখন দেখবা ভূতের পা ঝুলানির মজা!
শালু কাপড় পরা লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা একটা লোক এলো। মোছে ঢাকা ঠোঁট। তার আঙুল ভর্তি আংটি। কাঁধে ঝোলা। লোকটা কাঁধের ঝোলা থেকে একটা হাড় বের করে বলল, বল এটার রং কি?
সাদা।
‘সোঝা না বাঁকা?’
বাঁকা।
‘অল্পের জন্য রক্ষা। এই যে ভাই আপনারা সরে দাঁড়ান।’ বলেই লোকটা হাড় দিয়ে মাটিতে আমার চারপাশে বৃত্ত আঁকলেন। আর বললেন, ‘এই দাগের ভেতরে কেউ ঢুকবে না। ঢুকলে রোগীর বিরাট ক্ষতি হবে আর তোদের রক্তবমি হবে। এই রোগীর পক্ষের লোক কোথায়?
এক লোক বলল, ‘এখানে নেই। দাঁড়ান, আমি নিয়ে আসছি বলে লোকটি চলে গেল।’
ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলেন বাবা। বৈদ্য চিৎকার করে বলে উঠল, আপনারা কোনকালে কোন পূণ্য করেছিলেন বোধ হয়। নইলে এতক্ষণে এই ছেলেকে জ্যান্ত পেতেন না। কপাল ভালো আমি সময় মতো এসে পড়েছি। এখন বলেন, ছেলের চিকিৎসা করাবেন, নাকি নিয়ে যাবেন, আপনার ইচ্ছা।
আমি চিৎকার করে বললাম, বাবা আমার কিছুই হয়নি। আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।
বৈদ্য আঙুলে ইশারা করে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বাবাকে বলল, আপনি ভদ্রলোক মানুষ। আমাকে হাদিয়া স্বরূপ দুই হাজার এক টাকা পঞ্চাশ পয়সা দিলেই চলবে। এটা আমার ব্যবসা না; ছেলের জীবন-মরণ সমস্যা। যান, হাদিয়াটা নিয়ে আসেন। আমি শুরু করে দেই।
যাই ‘দুই হাজার এক টাকা পঞ্চাশ পয়সা’ নিয়ে আসি বলে বাবা ভিড় ঠেলে চলে গেলেন।
বৈদ্য আমার মাথায় লাল সুতা বেঁধে দিলেন। ঝোলা থেকে আধমরা একটা কাগলাস বের করে আমার মাথায় বসিয়ে দিলেন। তারপর বাবড়ি ঝাঁকিয়ে আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। দুই চোখ বন্ধ করলেন এবং প্রবল বেগে ভ‚ত-পেতœী, জ্বিন-পরিকে গালাগাল করতে লাগলেন। কাগলাসটি ঠেলে ঠেলে আমার মাথায়ই হাঁটার চেষ্টা করছে। আমার শরীর শির শির করছে। চোখ বন্ধ করে রাখলাম। বৈদ্য একটু পর পর গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিচ্ছে আমার মুখে। একজন বলল, বৈদ্যের তন্ত্র-মন্ত্রে মড়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায়। যার নাম দাংশু।’
হঠাৎ করে বৈদ্য উপরের দিকে তাকিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলতে লাগলেন। তারপর তিনি বাঁকা হাঁড়টা আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত টেনে নিয়ে বলল, চোখ মেল ব্যাটা। আমি চোখ মেললাম। বৈদ্য হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ছেলে এখন সুস্থ। কই, ছৈলের বাবা কই?
‘ওরে বাপরে, ছেলের বাবা আসতেছে’ বলেই লোকগুলি দৌড়ে পালাতে লাগল। বাবার সঙ্গে পুলিশের লোক।
পুলিশ এসেই বৈদ্যকে থাপ মেরে ধরে ফেলল আর বলল, ‘এই পাতানো খেলা আর কতদিন খেলবি, বলে পুলিশ তাকে নিয়ে চলে গেলো।
আমি বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি চলে গেলাম।