ভূতের বিয়ে

444

সুন্দরবনের একটা জায়গার নাম গেছো পাড়া। এই পাড়ায় থাকে কয়েক হাজার ভূত, গেছো ভূত, মামদো ভূত, পাতি ভূত, সেই ভূতের সর্দারের ছেলের নাম পিলব, পিলবের আজ বিয়ে। যেনোতেনো বিয়ে নয়। এ এক বিশাল আয়োজন। একেতো সর্দারের ছেলে তার উপরে ভূতদের মধ্যে সুর্দশন আর বীরও সে। বিয়ে নিয়ে কতোই না ভাবনা ছিলো সর্দারণীর। তার ছেলের যোগ্য ভূতনী কি আর পাওয়া যায়! যা পাওয়া যায়, হয় বয়সে কম না হয় লম্বায় কম, না হয় তো নাকটা ভোঁচা। অবশেষে পাওয়া গেলো একজনকে। যে সব থেকেই পিলবের উপযুক্ত। হবু বউ ভূতনীও কিন্তু কোন অংশে কম নয়।
পিলবের সাথে মারামারি করেই তবে সে তার যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। পিলবের ইচ্ছে ছিলো যে তার বউ হবে সে যেনো যুদ্ধে পারদর্শী হয়। এ ছাড়া একটু শিতি হতে হবে, কারণ সর্দারের পরেই তো পিলব সর্দার হবে। তার বউ সবার চেয়ে আলাদা না হলে তো রাজত্ব করতে পারবে না। মিত্তির আবার অনেক বাহানা ছিলো বিয়ে নিয়ে। তার একটাই কথা ভূত হয়েছি তো কি হয়েছে। আমি কি আর মানব জাতির চেয়ে কোন অংশে কম। তাই সে নিজে নিজেই লেখা পড়া শিখেছে। তালোয়ার চালানো শিখেছে। মানুষকে আর মুখ ভেংচিয়ে নয় দরকার হলে যুদ্ধ করে ভয় দেখাবে এটাই তার ব্রত ছিলো। মিত্তির বাবাও এক সময় সর্দার ছিলো। পিলবের বাবার কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে সর্দারের মর্যাদা হারিয়েছে। এর পর থেকে সে আর সর্দার না। পিলবের বাবা সর্দার। তবু পিলবের বাবা তাকে অনেক সমীহ করে। শত হলেও অনেক বয়সি সে। যাই হোক, মিত্তি সেদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখলো একজন মানুষ গাছের উপরে উঠে সব ফল পেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মিত্তিরতো গায়ে আগুন লেগে গেলো! মানুষগুলো এমনিতে সব গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে, তার উপরে তাদের এলাকায় এসে গাছ থেকে ফল পাড়ছে। কি করবে ভাবতে লাগলো। একটা বুদ্ধি ওর মাথায় আসলো। মিত্তি মেয়ের রুপ ধরে বললো- এই যে গাছ থেকে যে ফল পারছো, কাউকে জিজ্ঞাসা করেছো? লোকটি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলো- না, কাকে আবার জিজ্ঞাসা করবো, আমার ফলগুলো ভালো লাগছে তাই পাড়ছি। মিত্তি ভেবেছিলো লোকটা মগডালে তাকে দেখতে পেয়ে ভয় পাবে। কিন্তু লোকটা ভয়তো পেলোই না, উল্টো কথা শুনিয়ে দিচ্ছে।
মিত্তি তখন রেগে বললো ঠিক আছে গাছের ফল নিতে দিবো, যদি আমার সাথে মারামারিতে জিততে পারো। লোকটিও হেসে বললো- ঠিক আছে চলো মারামারি করি। আসলে লোকটা আর কেউ নয় পিলব ছিলো। পিলবের অভ্যাস হলো মাঝে মাঝে মানুষের রুপ ধরে গাছে বসে ফল খাওয়া আর একা একা গান করা। কিন্তু পিলব ঠিকই মিত্তি যে ভূত এটা বুঝে গেলো। কারণ এই জঙ্গলে কোন মেয়ে একা একা গাছের এতো উপরে উঠতে পারবে না। কিন্তু মিত্তির পরিচয় জানতো না বা মিত্তিকে সে চিনতো না। মিত্তির কাছ থেকে মারামারি প্রস্তাব পেয়ে পিলবের হাতটাও নিশপিশ করতে লাগলো, আহা কতো দিন মারামারি করি না।

দু’জনে গাছ থেকে নেমে শুরু করলো মারামারি। শর্ত হলো যে জিতবে সে এই জঙ্গলের সব গাছের ফল পেড়ে নিয়ে যাবে, কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু মিত্তি এতটুকু বুঝলো না যে, ওটা কোন ভূত। ওতো মানুষ ভেবে মারামারি কথা বলেছিলো। মিত্তি লোকটাকে রাজি হতে দেখে মনে মনে খুশি হলো। আহা কতো দিন মানুষদের মারি না, আজ ব্যাটাকে এমন শিক্ষা দেবো আর এই জঙ্গলে আসবে না।
অবশেষে মারামারি শুরু হলো। পিলব দুইটা ঘুষি মারো তো মিত্তিও দুইটা মারে। আবার মিত্তি ঘুসি মারে তো পিলবও মারে। এভাবে দুইজন দুইজনকে মারতেই লাগলো। কেউ কাউকে হারাতে পারছিলো না। বেশ অনেক্ষণ মারামারির পরে মিত্তির হুশ হলো। না, কোন মানুষতো এভাবে মার খেয়ে বেঁচে থাকার কথা নয়। তাহলে এ কে? ভূত না পেতিœ? মিত্তি সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলো তুমি কে? পিলব হেসে বললো, কেনো ভয় পাচ্ছো?, মিত্তি বললো না ভয় না, জানতে চাইছি। পিলব তখন বললো তুমি তোমার আসল রুপে আসো। তাহলে আমি বলবো আমি কে। মিত্তি ভাবলো কোন শক্তিশালী মানুষ হয়তো। আমার আসল রূপ দেখাই ব্যাটা ভয়ে এমনিতেই পালিয়ে যাবে। মিত্তি তখন আসল ভূতের রূপে পিলবের সামনে হাজির হলো। পিলব একটু চমকে উঠলো আরে এতো মেয়ে ভূত! আর দেখতেও বেশ। মারামারি ভালো করে আবার বুদ্ধিও আছে। পিলব তখন নিজের আসল রূপে মিত্তির সামনে হাজির হলো। মিত্তি পিলবকে চিনতো। দূর থেকে অনেক বার দেখেছে। মিত্তি একটু লজ্জা পেয়ে বললো, আসলে আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম কোন মানুষ গাছ থেকে ফল পেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই মারামারি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। পিলব হেসে বললো, তুমি খুব বাহাদুর ভূতনী। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। মিত্তি একটু লজ্জা পেয়ে বললো, -তোমাকে আমারও পছন্দ হয়েছে। এভাবেই ওদের পরিচয় হয়েছিল। পিলব সেদিন বাড়িতে ফিরে সর্দারনীকে সব খুলে বলে সাথে এ ও বলে, আমি মিত্তিকে বিয়ে করতে চাই, তুমি দেখে আসো। তোমার ওকে পছন্দ হবে। সর্দারণী খুশি হয়ে বলে আর দেখার কি আছে! আমি ওকেই তোর বউ করে আনবো। সর্দারও খুশি মনে ওদের বিয়ে মেনে নিয়ে সব কথা পাকা করে বিয়ের আয়োজন করতে লাগলো। বিয়েতে মিত্তির বাবা পিলবকে পাঁচ হাজার ইউক্যালিপটাস গাছ, কয়েক হাজার গরুর হাড়, আর কয়েক হাজার অন্য গাছ দিলো। যে সব গাছের মালিক ছিলো আগে মিত্তির বাবা, পিলবও খুশি হলো এতে, তার আধিপত্য বাড়বে এই সব গাছের উপরে। এ ছাড়া বিয়েতে পিলব মিত্তিকে বেগুনী পদ্ম আর বেগুনী মখমলের শাড়ী দিলো, এটাই ওদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। জঙ্গলের সবাইকে বিয়েতে নেমতন্ন করা হলো বিয়েতে।
বিয়েতে গরুর রক্তের স্যুপ, খাসির ঘিলুর রেজালা আর তিতি পাখির মাংশ সাথে বিন্নি চালের পোলাউ আর কচি ঘাসের দুধের পায়েশ রান্নার ব্যবস্থা করা হলো। পিলবের সাথে ওর বন্ধুরা আর পুরো এলাকার ভূতরা মিলে নাকী সুরে “আজ পিলবের বিয়ে, সানায় বাজিয়ে, স্যুপ খাবো, ঘিলু খাবো, পেট ভরিয়ে” গান গাইতে গাইতে বিয়ের দাওয়াত খেতে গেলো। ভূতদের প্রথা অনুযায়ী পুরোহিত আসলেন। মন্ত্র পড়ে পিলবকে শোনালেন। পিলব মন্ত্র পড়ে মিত্তির মাথায় ক্যাকটাস গাছের কাটার তাজ পরিয়ে দিয়ে মিত্তিকে বউ বলে মেনে নিলো। বিয়ে পড়ার শেষে সবাই খুব মজা করে খেয়ে বউ নিয়ে নিজেদের এলাকায় ফিরে আসলো। আর মিত্তির বাবা, মা মিত্তিকে চোখের জলে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিলো। পিলব আর মিত্তি সুখে শান্তিতে বাকী জীবন কাটাতে লাগলো।