ভুয়া নিয়োগের’ প্রতারকচক্র মাঠে‘

108

প্রবেশপত্র, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, প্রশ্নপত্র সবই দেয়া হয়। নেয়া হয় নিয়োগ পরীক্ষাও। জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার নেয়ার পর দেয়া হয় নিয়োগপত্র। যোগদান করতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। দেখা যায় সবই ভুয়া, প্রতারণা। ততক্ষণে সব শেষ। প্রতারকদের দেখা আর মেলে না। মাথায় হাত পড়ে ভুক্তভোগীদের। এধরনের দু’টি চক্রের সন্ধান পেয়েছে পিবিআই। গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিন সদস্যকে। চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে। দেশজুড়েই রয়েছে তাদের নেটওয়ার্ক। সক্রিয় রয়েছে আরও কয়েকটি চক্র। গ্রেপ্তারকৃতরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও দিয়েছে পিবিআইকে।
চট্টগ্রাম কাস্টম, বন্দর, রেলওয়ে, সেনাবাহিনী, প্রাইমারি শিক্ষক, পুলিশের এসআইসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়া তাদের জন্য কোনো বিষয় নয়। টাকা দিলেই মিলবে চাকরি। চক্রের সদস্যদের এমন প্রলোভনে পড়ে টাকা দিয়েছে কয়েকশ’ চাকরি প্রার্থী। এ সুযোগে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
পিবিআই বলছে, চক্রটি নিজেরা সব করছে তা নয়। সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থার কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারিও এতে জড়িত রয়েছে। টাকার বিনিময়ে তাদের সহায়তা করছে।
পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চক্রটি খুবই চতুর। তারা সব কাজ অতি নিখুঁতভাবে করে। যা সহজে ধরা পড়ার মত নয়। সংস্থার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করা, নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যানের সই করা প্রবেশপত্র দেওয়া, লিখিত, মৌখিক ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এমনকি পুলিশ ভেরিফিকেশন পর্যন্ত হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে নিয়োগপত্র নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যখন চাকরিতে যোগ দিতে যান, তখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ততক্ষণে প্রতারক চক্র মোবাইল বন্ধ করে গা ঢাকা দেয়।
জানা যায়, পিবিআই সরকারি সংস্থায় নিয়োগের নামে প্রতারক চক্র সক্রিয় থাকার বিষয়টি সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারে। এরপর তারা বিষয়টি তদন্তে নামার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি এনবিআর এর পক্ষ থেকে প্রতারকচক্রকে চিহ্নিত করার জন্য পিবিআইকে অনুরোধ জানানো হয়। এরপরই তদন্তে নামে পিবিআই। তদন্তে নেমেই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তারা চাকরি দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথা স্বীকারও করে।
পিবিআই সূত্র জানায়, মো. রিপন সিকদার (৩০) নামে প্রতারককে গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকার সবুজবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে নগরীর আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকায় পূরবী হোটেলে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় আতিকুর রহমান চৌধুরী নাদিম (৩০) ও তোফাজ্জল হোসেনকে (৫৪)। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা একটি পেনড্রাইভে সংরক্ষিত তথ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং প্রতারণার পুরো রহস্য উদঘাটন হয়েছে।
পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ চাকমা জানান, রিপন ও তোফাজ্জলের কাজ ছিল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চাকরি প্রার্থীদের সংগ্রহ করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা। আর বাকি প্রক্রিয়াগুলোর সিংহভাগ করতেন আতিকুর।
পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন জানান, এ চক্রের সদস্যরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নিরীহ লোকজনের কাছ থেকে। গ্রেপ্তার হওয়া চক্রটি এ পর্যন্ত মোট ৫৩ জন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা করে নিয়ে প্রতারণা করেছে। এর মধ্যে কাস্টম হাউজে ২৩ জনের নামে ভুয়া প্রবেশপত্র, ২০ জনের নামে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এবং ২১ জনকে তারা ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়েছে। বন্দরে একজনের নামে ভুয়া নিয়োগপত্র ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ইস্যু করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগের নামে চার জনকে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ২৭ জনের নামে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে নিয়োগের কথা বলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোক সংগ্রহ করে তাদের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই কাজে তারা নিজেরাই বিভিন্ন পদের জন্য ভুয়া প্রবেশপত্র, প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র, পুলিশ ভেরিফিকেশন ও নিয়োগপত্র বানিয়ে হোটেলে এনে নিয়োগপ্রার্থীর পরীক্ষা নেয়। নগরীর দু’টি হোটেলে তাদের নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া হয়। সম্পূর্ণ টাকা পাওয়ার পর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় কথিত নিয়োগপত্র। আতিকুরের কাছ থেকে জব্দ করা পেনড্রাইভে প্রশ্ন, উত্তরপত্র, নিয়োগপত্র, প্রবেশপত্রে বন্দর-কাস্টমসের কর্মকর্তাদের নাম, পদবি, সই, সিল একেবারে হুবহু। তবে যেসব স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করা হয়, এর সবাই জাল বলে জানতে পেরেছে পিবিআই।
গ্রেপ্তারকৃত আতিকুর জানান, তিনি নিজেই প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন। ১৩ লাখ টাকা হারিয়ে নিজেই প্রতারণায় নেমে যান। আনোয়ার হোসেন নামে তিনি কর্মকাÐ চালাতেন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর নীলফামারী থানায় অজয় ভট্টাচার্য নামে একজন প্রতারণার শিকার হয়ে মামলা করেন। ওই মামলায় আসামি হিসেবে আনোয়ার হোসেনের নাম আছে। পিবিআই জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছে, অজয় ও তার স্ত্রীর বড় ভাই মিলনের কাছ থেকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে চাকরি দেওয়ার নামে ২৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই আতিকুর।
পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন জানান, তারা এ চক্রের আরও সদস্যের নাম পেয়েছেন। তাদের ধরতে অভিযান চালানো হবে। এ চক্রের কারণে অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
জানা যায়, টাকা নেয়ার পর চক্রের সদস্যরা লাপাত্তা হয়ে যায়। তাদের খোঁজ আর মিলে না।