ভিসির দৌড়ে কে কোথায়

267

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে হচ্ছেন- এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। ক্যাম্পাসে এখন এইটিই আলোচনা। বর্তমান উপাচার্য ড. ইফতিখার উদ্দিন চৌধুরী কী স্বপদে বহাল থাকছেন, না নতুন মুখ দেখা যাবে মর্যাদাপূর্ণ এই পদে?
এখন পর্যন্ত ঘুরে ফিরে তিনটি নামই আসছে আলোচনায়। যার মধ্যে একটি নাম ভিসি’র, অপর দু’টি নাম হচ্ছে- বর্তমান উপ-উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. সেকান্দর চৌধুরী। এক এক সময় এক একজনের নাম আগে চলে আসে। একবার ড. ইফতিখারের নামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পরক্ষণে আবার ড. শিরীণের নামই তালিকার ওপরে স্থান করে নেয়।
সর্বশেষ সপ্তাহ খানেক আগে শোনা গিয়েছিলো, ড. সেকান্দর চৌধুরী সবাইকে টেক্কা দিয়ে ভিসি হয়ে যাচ্ছেন। পরে আবার জানা গেল, তাঁর নামে নাকি বিভিন্ন অভিযোগ গেছে। গতকাল হাওয়ায় ভেসে বেড়ালো যে খবরটি, সেটি ড. ইফতিখারের জন্য সুখকর নয়। তাঁকে নাকি মন্ত্রণালয় থেকে সাফ বলে দেয়া হয়েছে তাঁর মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। তাঁকে ১৫ জুনের মধ্যে সমস্ত কাজ শেষ করে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে ড. ইফতিখার সম্প্রতি দু’টি কাজ করেছেন, যা তাঁর প্রতি বঙ্গবন্ধু কন্যার সহানুভ‚তি আকর্ষণের জন্য সহায়ক হতে পারে। এই দুটি কাজের একটি ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ প্রবর্তন, অপরটি ‘বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। ভিসি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের অধিকাংশ সময় ড. ইফতিখারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ উঠেনি। কিন্তু শেষদিকে এসে সম্ভবত আর তিনি তাল সামলাতে পারেননি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম এবং টেন্ডারে কথিত ‘বাণিজ্যে’র অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু অভিযোগ উঠলেই যে তা সত্য হবে- এমন মনে করার কোন মানে হয় না। কারণ যে কোন অভিযোগই তো প্রমাণ সাপেক্ষ। তবে একাডেমিসিয়ান হিসেবে তাঁর যে সুনাম সেটা ড. ইফতিখার বজায় রেখেছেন সুন্দর একাডেমিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। গবেষণাটা শুধু তাঁর আমলে নয়, সব ভিসিদের আমলেই উপেক্ষিত ছিলো।
ড. শিরীণ ও ড. সেকান্দর আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। ড. ইফতিখারও প্রো-আওয়ামী লীগ। বরং তিনি ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগ তথা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছেন। চট্টগ্রামে বৌদ্ধিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা সৃষ্টিশীল কর্মোদ্যোগ এবং সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী অপশক্তি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সিভিল সোসাইটির আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ভিসির রেসে তাঁকে কিছুটা এগিয়ে রাখারই কথা।
ড. শিরীণ শিক্ষাবিদ এবং একই সঙ্গে সৃষ্টিশীল লেখক ও মুক্ত চিন্তাবিদ। তিনি একজন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠক ও নারীনেত্রী। ড. শিরীণ যদি উপাচার্য পদে নিয়োগ পান, তাহলে তিনিই হবেন এ পদের প্রথম নারী। নারী হওয়ার কারণে হয়তো উপাচার্য পদের ওপর তাঁর অধিকার আরো বাড়লো এবং একই কারণে উজ্জ্বলতর হলো তাঁর সম্ভাবনা। কারণ দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী। সরকারের বিঘোষিত নীতি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। ভিসি নিয়োগে এই নীতির যদি ব্যত্যয় না ঘটে, তাহলে উপাচার্য পদে ড. শিরীণই হতে পারেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রথম পছন্দ।
ড. শিরীণের অনেকগুলি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জার্নালে তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নজরুলের উপর তাঁর গবেষণা প্রশংসিত হয়েছে। ড. শিরীণের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের তিনজন ঔপন্যাসিক’ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
কক্সবাজার জেলার একটি আওয়ামী পরিবারে ড. শিরীণের জন্ম। তাঁর পিতা আফছার কামাল চৌধুরী কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। একাত্তর সালে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গঠিত জেলা সংগ্রাম কমিটির আহŸায়ক নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাকশাল কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেছিলেন। বাকশালের গভর্নরও করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তিনি রাজি হননি।
ড. শিরীণ স্কুল ও কলেজ জীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির চর্চা করে আসছেন। ৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য লালদিঘিতে আয়োজিত এক জনসভায় বালিকা শিরীণও উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রেখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১০ বছর।
ড. শিরীণ আখতারের ছোট ভাই আসিফ কামাল রাবু চট্টগ্রামের একজন শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতা ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে শিবির খেদাও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন রাবু এবং তাঁর স্ত্রী কাবেরী সরওয়ার নাজনীন। শিরীণের ভ্রাতৃজায়া কাবেরী কক্সবাজারের আরেকজন প্রধান আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক সাংসদ, রাষ্ট্রদূত ও শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলমের কন্যা।
কাবেরী বর্তমানে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং মহিলা আসন থেকে নির্বাচিত এমপি। তাঁর স্বামী রাবুর অকালে জীবনান্ত না হলে, তিনি যদি কক্সবাজারে রাজনীতি করতেন, তাহলে সেখানকার আর না হলে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃপদে অধিষ্ঠিত হতেন। রাবুরই একান্ত ঘনিষ্ঠ মফিজুর রহমান বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
ড. শিরীণের স্বামী লে. কর্নেল লতিফুল আলম চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা। বিপথগামী সেনাশাসক স্বৈরাচারী জিয়া হত্যার প্রহসনমূলক মামলায় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বিনা বিচারে তাঁর জীবনের মূল্যবান ১০টি বছর ধ্বংস হয়ে যায়।
ড. শিরীণ-মানস কি উপাদান দিয়ে গঠিত, তা বোঝানোর জন্য এসব ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য জরুরি মনে করেই উল্লেখ করলাম।
ড. সেকান্দর চৌধুরী বিশিষ্ট গবেষক এবং শিক্ষাবিদ। স্মিতহাস্য, মিষ্টভাষী, সজ্জন সেকান্দর সাহেব ক্যাম্পাসের একটি জনপ্রিয় নাম। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক সমিতি, ডিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠিত করার মধ্যদিয়ে তিনি বিশিষ্ট শিক্ষক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকাÐেও সুযোগ পেলে তিনি যোগ্য ভ‚মিকায় অবদান রাখেন। শহরের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
দেশে এবং বিদেশে স্বীকৃতিমানের জার্নালে তাঁর অনেক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ড. সেকান্দরের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলার মুসলিম সমাজ ও রাজনীতি’ সুধীমহলের প্রশংসা অর্জন করেছে।
পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় বেঈমান তাঁবেদার চক্রের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীর যে পরাজয় ঘটে, তা শুধু দুটি যুধ্যমান দলের জয়-পরাজয় মাত্র নয়, বরং এর তাৎপর্য ছিল শতাব্দীপ্রসারী। সেদিন নবাব বাহিনীর পরাজয়ের মধ্যদিয়ে প্রকৃতপক্ষে এ দেশ ও উপমহাদেশের মুসলমানদেরই পতন ঘটে, যার কুপ্রভাব এখনও সক্রিয়। তবে পরাজয়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে মুসলমানরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। এসবই আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। বাংলার মুসলিম সমাজ ও রাজনীতি সেসব ইতিহাসেরই একটি নির্ভরযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ।
বইটিতে বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের বিভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়া, সা¤প্রদায়িক রাজনীতির উদ্ভব, সা¤প্রদায়িকতাকে পুষ্ট করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং এগুলোর প্রতিক্রিয়া, কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ব্যর্থতা, মুসলমানদের রাজনীতি এবং প্রতিদ্ব›দ্বী দলসমূহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, স্বল্পায়ু কৃষক প্রজা আন্দোলনের দুর্বলতায় মুসলিম লীগের উত্থান, রাজনীতির গতিধারায় বাংলার মুসলমান নেতৃত্ব ও জনসাধারণের সম্পৃক্ততা এবং সর্বোপরি বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিপরীতে স্বতন্ত্র মুসলিম জাতীয় চেতনা শক্তিশালী হওয়ার সুদূরপ্রসারী ঘটনাবলি মূল্যায়ন করা হয়েছে।
উপযুক্ত তিনজন ছাড়া আরও তিনজন শিক্ষক রয়েছেন, যাঁদের নাম এখন কম আলোচিত হলেও, ভিসি নির্বাচনের তোড়জোর যখন শুরু হয়, তখন এঁরাও আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন। এই তিন শিক্ষক হচ্ছেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. ফরিদউদ্দিন আহমদ, অ্যাকাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতান আহমদ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কমিশনার অধ্যাপক হেলালউদ্দিন নিজামী। তাঁরা এখনো আছেন ট্র্যাকে, হয়তো কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন কিন্তু এখনো দৌড়াচ্ছেন।
বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপমন্ত্রী জনাব মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল চট্টগ্রামের বাসিন্দা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মনোনয়নের ক্ষেত্রে তাঁর ভ‚মিকা রাখার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে তিনি কী ভ‚মিকা রাখেন সেটাই দেখার বিষয়।