ভাড়া না বাড়িয়ে গণপরিবহন পরিচালনা করা যেত যেভাবে

82

করোনা মহামারির মধ্যে সারা দেশে গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার কারণ দেখিয়ে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।
গত রবিবার এই বর্ধিত ভাড়ার প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এরইমধ্যে এই ভাড়া নিয়ে সাধারণ যাত্রী ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বর্তমানে ভাড়া বাড়িয়ে গণপরিবহন পরিচালনার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা অযৌক্তিক। এটি দেশের সাধারণ নাগরিকদের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সাবরিনা মুস্তারী নামে বাসে যাতায়াতকারী এক কর্মজীবী নারী মন্তব্য করেন, গত তিন মাস ধরে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলাকালে দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার অজুহাতে ঠিকমতো বেতন-ভাতা পরিশোধ করেনি, ঈদে বোনাস দেয়নি। এ অবস্থায় পকেট খালি হওয়া সাধারণ মানুষ জীবন বাজি রেখে কাজের জন্য ঘর থেকে বের হতে গিয়ে কী করে অতিরিক্ত বাস ভাড়া দেবেন সেটা মোটেও ভাবা হয়নি।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেখানে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে একের পর এক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেই যাচ্ছেন, সেখানে জ্বালানি তেলের দাম না কমিয়ে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি গণমানুষের সঙ্গে সরকারের প্রতারণারই শামিল। সরকারের অন্য কর্মসূচিগুলোরও পুরো বিপরীত। এখানে গণমানুষের স্বার্থ মোটেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণপরিবহনের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের নামে যে টাকা আদায় হয় তা বন্ধ করলেই মালিক ও যাত্রীদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ কমবে। তাছাড়া এখন আগের মতো যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে বসে থাকতে হচ্ছে না। তাই অতিরিক্ত জ্বালানিও ব্যয় হবে না। আর করোনার আগে সরকার নির্ধারিত যে ভাড়া ছিল সেই ভাড়ার চেয়েও পরিবহনগুলো অনেক বেশি ভাড়া আদায় করতো। এর ফলে নতুন করে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির কারণে তা আরও অনেক বেড়েছে।
তাদের দাবি, ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ও ২০১৬ সালের ৩ মে সরকার আন্তনগর ও দূরপাল্লায় চলাচলকারী বাস মিনিবাসের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সেটাও অনেক বেশি ছিল। তা নিয়েও তখন যাত্রী অধিকার সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাছাড়া ভাড়া বাড়ানোর সময় সংশ্লিষ্ট কমিটি একটি বাসের ২০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকবে সেই চিন্তা করেই ভাড়া নির্ধারণ করে থাকেন। এ হিসাব একটি ৫০ আসনের বাসে ১০টি সিট ফাঁকা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি এই ফাঁকা থাকা আসনের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ২৫টিতে দাঁড়াবে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহনে দৈনিক যে হারে চাঁদা আদায় হচ্ছে সেটা বন্ধ করা গেলেই পরিবহন মালিকদের ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও যাত্রীদের ওপর চাপ করতো। এটি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভাড়া বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। এরইমধ্যে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোও চাঁদা আদায় না করার কথা জানিয়েছে। তাছাড়া আগে যে সময়ে একটি বাস যানজটের কারণে দৈনিক তিনটি ট্রিপ দিতে পারতো সেখানে এখন এগুলো দ্বিগুণেরও বেশি ট্রিপ দিতে পারবে। এতে পরিবহনের পরিচালনা বা জ্বালানি ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসবে। অপরদিকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে। সরকার চাইলে দেশে জ্বালানি তেলে দাম কমিয়েও পরিবহন ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। প্রয়োজনে কিছুটা ভর্তুকিও ঘোষণা করা যেতো।
২০১৬ সালের ৩ মে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আন্তনগর ও দূরপাল্লার রুটে বাস/মিনিবাস চলাচলের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটার ১.৪২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত বাস ও মিনিবাসের সর্বোচ্চ ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ১.৭০ এবং ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১.৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর পরিবহনের সর্বনিম্ন ভাড়া ঢাকার জন্য ৭ টাকা ও চট্টগ্রামের জন্য ৫ টাকা ধার্য করা হয়।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ভাড়া বাড়ানো মালিক, শ্রমিক ও সরকারের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যারাই যখন ক্ষমতায় আসছে তখন তাদের দলের মধ্যে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা ঢুকে পড়ে। আজ শুধু করোনায় নয়, সব সময়ই তারা ভাড়া বৃদ্ধি করে মানুষকে কষ্ট দিয়ে থাকে। এটা চাইলেই মিনিমাইজ করা যেতো।
তিনি আরও বলেন, আজ বিশ্ববাজারে তেলে দাম কমেছে। বাংলাদেশে কেন কমছে না? তেলের দাম কমিয়ে পরিবহন ব্যয় কমানো যেতো। তাছাড়া শ্রমিক সংগঠন ও মালিকরা বলেছে তারা আর চাঁদা আদায় করবে না। তাহলে এই টাকাটা তো বেঁচে গেলো। আর সীমিত পরিসরের কারণে এখন গণপরিবহনগুলোকে আগের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে জ্বালানি পোড়াতে হবে না। এক জ্বালানি দিয়ে এখন দুই থেকে তিনগুণ বেশি ট্রিপ দেওয়া যাবে। তাহলে তো ভাড়া বাড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই।
করোনাকালে গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে বর্ধিত বাস ভাড়া স্থগিত ও বিআরটিএ’র ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি পুনর্গঠনের দাবি করেছে কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি। সংগঠনটি বলছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কম যাত্রী নিয়ে বাস-মিনিবাস পরিচালনার জন্য মালিকদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি জনগণের ওপর না চাপিয়ে সরকারি প্রণোদনার আওতাভুক্ত করতে পারতো। কিন্তু, বিকল্প কোনও উপায় না খুঁজে বিআরটিএ’র ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি সরাসরি জনস্বার্থবিরোধী সুপারিশ করেছে। ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির ভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় ওই কমিটি বাস মালিকদের অনৈতিক স্বার্থরক্ষার তল্পিবাহকে পরিণত হয়েছে।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দীন চৌধুরী বলেন, আসলে সরকার চাইলে বিভিন্নভাবে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। বিশেষ করে গণপরিবহনে যেভাবে চাঁদাবাজি হয় সেটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আগের ভাড়া অনুযায়ী পরিবহন চালানোর যেতো। তাছাড়া যদি কিছুটা ভর্তুকির প্রয়োজন হতো সরকার তাও দিতে পারতো। সরকার অন্য সব সেক্টরে ভর্তুকি দিতে পারলে যেখানে সরাসরি জনগণ জড়িত তাদের ক্ষেত্রে কেন পারবে না? আমরা মনে করি সরকার মালিক ও শ্রমিক নেতাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। সে কারণে তাদের অনুরোধে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এই মুহূর্তে ভাড়া বাড়ানো আমাদের জন্য ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সময়ে মালিকরাও কিছুটা লাভ কম করে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতো।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, স্বাস্থ্যবিধির কারণে পরিবহনগুলোকে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখেই যাত্রী পরিবহন করতে হবে। এতে অর্ধেক আয় কমে যাচ্ছে। এ কারণে মালিকদের দাবি ছিল ভাড়া বাড়ানোর। আর ভাড়া কিন্তু মালিকরা করেনি। এর জন্য একটা কমিটি আছে। কমিটি পর্যালোচনা করে সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশ থেকেও আরও ২০ ভাগ কমিয়ে সরকার ভাড়া নির্ধারণ করেছে।
এদিকে ভাড়া সমন্বয় সংক্রান্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একটি কমিটি রয়েছে। গত ৩০ মে কমিটি ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ৩১ মে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. ইউছুব আলী মোল্লা (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, এখন স্বাস্থ্যবিধির কারণে বাসগুলো অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখতে হচ্ছে। এ কারণে মালিকরা দাবি করেছেন তাদের পরিবহন ব্যয় মেটাতে ভাড়া বাড়ানো প্রয়োজন। তাই ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে কমিটির মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ পাঠিয়েছে। বাকি সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ই নিয়েছে।
তবে বাড়তি ভাড়ার জন্য যে সুপারিশ বিআরটিএ’র কমিটি করেছে তাতে বাস মালিকদের দাবি বিবেচনা করা হলেও বাসগুলোর ট্রিপ সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা, যানজট কম হওয়ায় জ্বালানি খরচ কমে যাওয়া, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমার কারণে বাংলাদেশেরও কমানোর প্রস্তাব এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে কমিটি কোনও তথ্য জানায়নি।