ভাসানচর নিয়ে ‘আতঙ্ক’ ছড়ানোর অভিযোগ

53

টেকনাফের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের মাঝে অপপ্রচার ও আতঙ্ক ছড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভাসানচরকে ‘মরার চর’ বলে অভিহিত করে একটি চক্র আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তারা বলছে, ভাসানচরে গেলে সবাই মারা পড়বে। সেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার পেছনে চীন ও মিয়ানমারের ষড়যন্ত্র রয়েছে। টেকনাফের শালবাগান, লেদা ও জাদিমুড়া রোহিঙ্গা শিবিরের ভাসানচরে যেতে রাজি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, রোহিঙ্গাদের কাছে ঠেঙ্গারচর নামে পরিচিত ভাসানচরে স্বেচ্ছায় যেতে রাজি রোহিঙ্গাদের তালিকা নেওয়া হচ্ছে। ভাসানচর নিয়ে একটি চক্র ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে, এমন খবর আমিও শুনেছি। এই বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি ও টেকনাফের জাদিমুড়া এবং শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা খালিদ হোসেন বলেন, আমার নিয়ন্ত্রিত দু’টি শিবির থেকে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি রোহিঙ্গাদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিদিন এই তালিকা বড় হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে সেখানে না যায়, এজন্য একটি গ্রæপ অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করছে। এই বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
শরণার্থী শিবিরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্যাম্পের মাঝি (নেতা) ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রতিদিন ভাসানচরের বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। সেখানকার পরিস্থিতি ভিডিও মাধ্যমে তাদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। অনেকেই সেখানে যেতে আগ্রহী। ভাসানচরে যেতে রাজি রোহিঙ্গার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
উন্নত জীবনের আশায় তিন মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান নিয়ে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি লেদা ক্যাম্পের আনোয়ারা বেগম (৩২)। তিনি বলেন, ‘ঠেঙ্গারচর মারারচর, তুয়ারা হেরে যাইলে মরি যাইবাগই’ (ভাসানচর মৃত্যুরচর। তোমরা সেখানে গেলে মারা যাবেই)। ভাসানচরে গেলে আত্মীয়-স্বজন দেখতে আসতে পারবে না। সেখানে ভালো খাবারও মিলবে না। এছাড়া শিবিরে ত্রাণসহ অন্য কার্ড রয়েছে, সেগুলো নিয়ে নেবে। শিবিরের লোকজনের কাছে এসব কথাবার্তা শুনে, এখন ভাসানচরে যেতে ভয় পাচ্ছি।
আনোয়ারা বেগম আরও বলেন, এসব কথা মনে আর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অশান্তির জ্বালায় মিয়ানমার থেকে এখানে এসেছি আবার এখান থেকে সেখানেও যদি অশান্তি হয়, তা কি ভালো হবে? এমনকি ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার পেছনে চীন ও মিয়ানমারের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে শিবিরে প্রচার রয়েছে। ফলে ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি।
রোহিঙ্গা এক নারী বলেন, সেখানে গেলে আর আসা যাবে না। সেখানে যাওয়ার চেয়ে এখানে থাকা অনেক ভালো। এছাড়া আরও অনেক কথা বলাবলি করছে লোকজন। বলা হচ্ছে, সেখানে পানি ওঠে। ভাসানচর, ভাসমান থাকবে পানিতে।
স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে আগ্রহী নূর বানু বলেন, অন্যদের মতো আমিও ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু এখন শিবিরে লোকজন বলাবলি করছেন বড় বড় ঘর দেখিয়ে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আসলে সুযোগ-সুবিধা কম। তাছাড়া বর্ষার সময় সেখানে পানি উঠে ডুবে যায়। সেরকম হলে কী করে সেখানে যাবো?
কয়েকদিন আগেও ভাসানচরে যেতে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন নূর হোসেন। তিনি লেদা শরাণার্থী শিবিরের ডি-বল্কের মাঝি। তিনি বলেন, লোকজন কী বলাবলি করছে, তাতে কিছু যায় আসে না। তবে সেখানে যাওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে যেতে হবে। এর আগে সেখানে যাবো না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনপ্রতিনিধি বলেন, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গা এখান থেকে সরানো গেলে কিছুটা বোঝা কমবে। একটা শ্রেণি রোহিঙ্গাদের পুঁজি করে লাভবান হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হাওয়ার পেছনে কিছু এনজিও ও রোহিঙ্গা নেতারা জড়িত ছিল। এবার ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের বিষয়টি ব্যর্থ করার চেষ্টা চলছে।
র‌্যাব-১৫, সিপিসি-১ এর টেকনাফ ক্যাম্প ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, যেসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভাসানচরের বিষয়ে গুজব চালাচ্ছে, সেখানে র‌্যাবের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যারা এসব কাজে জড়িত, তাদের দ্রæত আইনের আত্ততায় আনা হবে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভাসানচরের বিষয়ে ভুল ব্যাখা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হবে। তবে কত রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে, তা বলেননি তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে প্রথম ভাসানচরে শরণার্থীদের বসবাসের জন্য আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। সেসময় চরটিতে কোনও জনবসতি ছিল না। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের চাপ কমাতে ২০১৮ সালের ফেব্রæয়ারিতে উন্নত সুবিধাসহ নোয়াখালীর ভাসানচরে ৪৫০ একর জমির ওপর শিবির নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে নৌবাহিনী।