ভাষা দূষণ : বাংলা ভাষা বিলুপ্তির পথে!

441

পৃথিবীতে বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, মাতৃভাষা বাংলার জন্য শত শত প্রহসন-নির্যাতন সহ্য করেছে, রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। ভাষার অধিকার ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন পরবর্তীতে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের পথকে ত্বরান্বিত করেছে। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলার সকল প্রতিবন্ধকতা একাত্তর পরবর্তী সময় থেকেই দূর হয়েছে। বাঙালিরা পেয়েছে অবাধে বাংলা বলার স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা। দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু হয়েছে। বাংলা ভাষা পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বাংলা ভাষার মর্যাদা এখন কোনো অংশেই কম না। কয়েকটি দেশে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবেও বাংলা ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলা ভাষার এমন আন্তর্জাতিকীকরণ সত্যই প্রসংশনীয়।
বাংলা ভাষার নিজস্ব কাঠামো, গঠনতান্ত্রিকতা অবশ্যই রয়েছে। বাংলা ব্যাকরণবিধি ও ভাষা ব্যবহারের নানা নিয়ম-কানুন আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলা ভাষা চর্চা করানো না হলেও শিক্ষার্থীরা বাংলা পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে বাংলা ভাষার ব্যবহার শিখছে। ‘বাংলা সাহিত্য’ বাংলা ভাষা শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু আশঙ্কা হল- পরবর্তীতে তারা কি সবাই বাংলা ভাষার স্বকীয়তা, মৌলিকতা বজায় রেখে চলতে পারছে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে শিক্ষিত ব্যক্তিরাই বাংলা ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। বিকৃত উচ্চারণ, বাংলা ভাষার সাথে বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণের সূচনা শিক্ষিতদের হাত ধরেই শুরু হয়েছে, চলছে। তাদের ব্যক্তিত্বকে উচ্চপর্যায়ে সমাসীন করতে বাংলাকে করছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য। ভাষা ব্যবহারে বিন্দুমাত্র শুদ্ধতার বালাই নাই। এটি বাংলা ভাষার জন্য ভয়ংকর বটে।
শিক্ষিত শ্রেণিকে দোষ দেওয়া হচ্ছে কি না, তা ঠিক বোঝা মুশকিল আমার নিজের পক্ষেই! তবে তাদের দ্বারা সকলে প্রভাবিত, এ কথা সত্য শতভাগ। তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত অর্ধেক বাংলা, অর্ধেক অন্যভাষা ছড়িয়ে পড়ছে সবার মাঝে। পরিবার থেকে সমাজে, সমাজ থেকে দেশে। যারা বাঙালি, তারা স্বভাবতঃ জন্মের পর শুধু বাংলা বলার অভ্যাস গড়ে তুলেছে। উচ্চারিত প্রথম বাংলা শব্দ ‘মা’। পরিবার শুদ্ধ বাংলা শেখাতে না পারলেও মূলধারার বাংলা শিখিয়েছে, আঞ্চলিক ভাষা শিখিয়েছে। এই নয় যে তারা ভাষার সংমিশ্রণ করে কথা বলা জন্মের পর পরই সন্তানকে শিখিয়েছে। ধীরে ধীরে সংমিশ্রণকৃত ভাষা প্রবেশ করেছে। যার ফলে শুদ্ধ বাংলা বলার সুযোগ হারিয়েছে ছোট্ট শিশুটিও। ‘সবাই তো এভাবেই বলছে, আমিও বলি।’ শিখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই যে ভাষার সংমিশ্রণ যেকোনো ভাষার জন্য চরম অবমাননাকর।
বাঙালি জাতি গোষ্ঠির প্রয়োজনবোধে, আন্তর্জাতিক পরিমÐলে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে, যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে ইংরেজি ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। অভিবাসি, প্রবাসি কিংবা বিদেশি পর্যটকদের প্রভাবে হিন্দি, উর্দু, আরবি, ফারসি ভাষাসহ বেশকিছু ভাষা বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছে। এতে কোনো আপত্তি নেই। মানুষ যখন বিচিত্র ভাষায় কথা বলতে পারবে, তখন সেটা তার জন্য সম্মানজনক হতে পারে। কিন্তু তখনই অসম্মানজনক হবে, যখন সে বা তারা সবগুলো ভাষার সংমিশ্রণ করবে। যখন ইংরেজি বলার দরকার হবে, তখন শুধু ইংরেজিতেই কথা বলতে হবে। কিছু ইংরেজি, কিছু বাংলা কিংবা কিছু অন্যভাষা ব্যবহার ভাষার জন্য ক্ষতিকর- এই বোধটুকু বহুভাষিদের মাঝে নেই বললেই চলে।
বাংলা ভাষায় কত বাংলা শব্দ আছে, তা কারও বোধগম্য নয়, সুনির্দিষ্ট নয়। ৫০টি বাংলা বর্ণমালা দিয়ে তৈরি আজকের বাংলা ভাষার লিখিত রূপ। বিদেশি ভাষাও বাংলায় অনুপ্রবেশের মাধ্যমে বাংলা হয়ে গেছে। যেগুলো এ যুগের নয়। এবং এর প্রভাব বাংলা ভাষার জন্য সুখকর। যেসব ইংরেজি শব্দের কঠিন বাংলা অর্থ কিংবা বাংলা অর্থ নেই, সেসব ব্যবহারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। শব্দ বিশেষ অন্যভাষার মাধ্যমে আমরা যে কোনো বিষয়কে উপস্থাপন করতে পারি, তার মানে এই নয় যে একটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য ব্যবহারে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ করব।
আমাদের ব্যবহারিক নানান জিনিস-পত্রের নাম ইংরেজি, উর্দু, পর্তুগাল, আরবি, ফারসি ইত্যাদি ভাষা থেকে অধিগ্রহণকৃত। এসবের সুনির্দিষ্ট বাংলা কোনো অর্থ নেই, থাকলেও বেশ কঠিন, বোধগম্য নয়। এগুলোর মার্জিত ব্যবহার বাংলা ভাষাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে, সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। অতএব এগুলো বাংলা ভাষারই অংশবিশেষ, উপাদান।
হতাশাজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে বর্তমান প্রজন্ম শুদ্ধ বাংলা ভাষা ব্যবহারে যতটা না অদক্ষ, তার চেয়ে বেশি অমনোযোগী। কিছু ক্ষেত্রে শুধু বাংলা বললে অপমানিত হতে হয়। ‘ও তুই তো ইংরেজি পারিস না আবার।’ আবার শুধু বাংলা বললে অনেকে ‘কবি’ বলে আখ্যায়িত করে যেন কবিকূলই শুধু মৌলিক বাংলা ভাষা ব্যবহারের যোগ্যতা রাখে। মোদ্দা কথা হল- বর্তমান প্রজন্ম ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে চরম উদাসীন। পাশ্চাত্য ভাষার অঢেল অনুপ্রবেশ, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাষা বিকৃতির অসম প্রতিযোগিতা ভাষার মৌলিকতার মানদণ্ডকে সমূলে বদলে দিয়েছে। অনেক সময় বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে কোনটা কোন ভাষার শব্দ থেকে উৎসারিত। শুধু তাই নয়, বাংলার উচ্চারণ ইংরেজি অক্ষরে লিখে হরহামেশা ব্যবহার করা হচ্ছে; যাকে আমরা ‘বাংলিশ’ বলে থাকি। পরীক্ষার খাতাতেও এমন লেখার উদাহরণ গণমাধ্যমে এসেছে।
বাঙালিদের বাঙালি সত্তার প্রতি অবহেলার কারণে বাংলার মৌলিকতা বজায় রাখার বিষয়ে কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। ‘যাক না বাংলা ভাষা রসাতলে।’ সবার মুখের ভঙ্গিমা দেখলে মনে হয়, ‘কি দরকার ছিল বাংলা ভাষার জন্য এত সংগ্রাম করার? কি দরকার ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার? আজ যদি অন্যকোনো ভাষা আমরা শিখতে পারতাম, তাহলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তো। দেশটা আরও উন্নত হতো।’ অনেকে বলে, ‘বাংলা অনেক কঠিন ভাষা। তার চেয়ে উর্দু থাকাই ভালো ছিল।’ ভাষা জ্ঞানের অভাববোধ, দেশের প্রতি ভালোবাসাহীনতা থেকে অনেকের মুখে বাংলা ভাষা বিরোধি নানান কথা শোনা যায়। যারা নিজেরা যেমন বাংলা ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, তেমনি অন্যকে উদ্বুদ্ধ করে। এঁরা দেশের ভাষাশত্রু। এঁদের বিচার কাম্য।
বাংলাদেশে শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি, আবরি কিংবা প্রশিক্ষণের জন্য অন্যভাষা শেখানো হয়। এর কোনো নেতিবাচক দিক দেখছি না। বরং বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্যভাষা বলা ও ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন অবশ্যই ইতিবাচক দিক। আজকাল বাংলাদেশেই অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যেখানে শুধু ইংরেজিতে পাঠদান করানো হয়ে থাকে। ভিন্নভাষা শেখার জন্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। এটিও উল্লেখযোগ্যভাবে সঠিক। কিন্তু সঠিক নয় কোনটা? যখন এই সকল ভিন্নভাষা চর্চাকারী বাঙালিরা যখন উভয় ভাষার সংমিশ্রণ করে কথা বলে, তখন তা মারাতœক ভাষা দূষণ হয়ে ওঠে। তবে দুঃখজনক, বিদেশি ভাষা শেখার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান চোখে পড়লেও বাংলা ভাষা শেখার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান চোখে পড়ে না। বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। নচেৎ অন্যভাষার অনুপ্রবেশ যেকোনো সময় বাংলা ভাষাকে বিলীন করে ফেলতে পারে। বিজ্ঞদের আশঙ্কাও এমন যে ভাষা দূষণের কবলে পড়ে বাংলা ভাষা বিলুপ্তি হয়ে যেতে পারে।
ভাষা সর্বদাই পরিবর্তনশীল। তাই বলে এতটা পরিবর্তন হবে যে মূলধারার ভাষা নির্ণয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হবে- এটা কেমন কথা! বাংলার সাথে অন্যান্য ভাষার জগাখিচুরি ব্যবহার, উদ্ভট শব্দ তৈরি, উচ্চারণ, দেওয়ালে, পত্রিকায়, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখে প্রচার যেন সকল শ্রেণিকেই চরমভাবে প্রভাবিত করছে। যার ফলে ভাষার জন্য যুদ্ধকারী বাঙালিরাই আজ ভাষা ব্যবহারে আহাজারিতে আছে। কেউ প্রকৃত বাংলা উচ্চারণ করে স্বস্তিতে আছে, কেউ অস্বস্তিতে যে তার শুদ্ধ বাংলার গ্রহণ যোগ্যতা নেই। বাধ্য হয়ে তাকে সংমিশ্রণ করে বলতে হচ্ছে। যেখানে মৌলিক বাংলা ব্যবহারে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, সেখানে ভিন্নভাষার ব্যবহারে বাংলা বলার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে।
অনেকে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকীকরণের কথা বলে। (যদিও বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে; এটি বজায় রাখা জরুরি।) কিন্তু কখন বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকীকরণ হবে, যখন বাঙালি শুদ্ধভাবে বাংলাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারবে। ভাষার সংমিশ্রণ নিয়ে বাঙালি কখনই ভাষার দিক দিয়ে একক সফলতা আনতে সক্ষম হবে না। এজন্য বাঙালিদের ভাষাপ্রীতি বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলা ভাষা ব্যবহারে অত্যন্ত যতœশীল হতে হবে। আমি আপনি চাইলেই ভাষার সংমিশ্রণ না করে পারস্পরিক যোগাযোগ বজায় রাখতে পারব- এ মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে অবশ্যই ভিন্নভাষা ব্যবহার করতে হবে, তাই বলে অন্যকোনো ভাষার সাথে অন্যকোনো ভাষার সংমিশ্রণ করে নয়।
অতএব, লিখন ও পঠনে বাংলার নিজস্বতা বজায় থাকুক। সকলের ভাষাপ্রীতি জাগ্রত হোক। বাংলা ভাষা ফিরে আসুক তার মূলধারায়, সর্বত্র শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, বাংলা ভাষা চর্চার জন্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। একজন বাঙালি হিসেবে সে প্রত্যাশা রাখি। এসব প্রত্যাশা পূরণ হলে আমরা নিজেদেরকে খাঁটি বাঙালি হিসেবে গর্বের সাথে পরিচয় দিতে পারব।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট