ভালোবাসার আরেক নাম ডায়াবেটিস

212

একজন ডায়াবেটিক রোগী হিসেবে প্রায় নিয়মিত ডায়াবেটিস হাসপাতালে যাওয়া-আসা করতে হয়। দেখা হয় অনেক মুখের, তাঁর মধ্যে পরিচিত লোক যেমন থাকে তেমনি থাকে অসংখ্য অপরিচিত লোক। দূর দূরান্ত থেকে সেই সকালে এসে খালি পেটে, আর খাওয়ার দু’ঘণ্টা পরের রক্ত পরীক্ষার জন্য দিয়ে অপেক্ষা করতে হয় কখন ডাক্তারের ডাক পড়ে। অবশ্য পুরানো রোগীদের খাওয়ার দু’ঘণ্টা পরের রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। ডাক্তারের কক্ষে প্রবেশ করতে করতে ডা. সাহেবের চোখ দেখেই বুঝতে পারা যায় রোগীর ডায়াবেটিসের হাল হকিকত। যখন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে রোগীর মন যেমন ফুরফুরে থাকে তেমনি ডা. সাহেবও থাকেন হাসিখুশি।
ডায়াবেটিস হাসপাতালে একজন রোগী আরেকজন রোগীর সাথে ভাববিনিময় করে। এতে করে অনেকের সাথে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠতা। ফলে পরস্পরের রোগের অবস্থা, পারিবারিক নানা সুখ-দুঃখের কথাও শেয়ার করার সুযোগ ঘটে। একদিন ষাটোর্ধ এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলো, হাতে পানির বোতল। তিনি কথায় কথায় বললেন, বাসার কারো কথা আমার ভালো লাগে না। তাই সবাইকে বলে দিয়েছি তোমরা প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে কথা বলবে না। আমি বললাম ঠিক বলেছেন, ওনাদের কথায় যদি আপনার মাথা গরম হয় তাহলে কথা না বলাই ভালো। আর একদিন দেখা হলো এক ফুটফুটে মেয়ের সাথে। বয়স আঠার পেরিয়েছে সবে। ভার্সিটিতে পড়ে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি এখানে এসেছ কেন? সে হাসিমুখে বলল, আমার ডায়াবেটিস। সুগার টেস্টের জন্য এসেছি। আমি অবাক হলাম। এত অল্প বয়সে ডায়াবেটিস? তাকে বললাম তোমার ডায়াবেটিস কীভাবে হলো? সে কোনো রকম জড়তা ছাড়া মিষ্টি করে জবাব দিলো , আমি ছোটোবেলা থেকে বেশি বেশি মিষ্টি খেতাম, তাই। কিশোরী মেয়েটির মনের জোর দেখে আমার মনের জোর বেড়ে গেল শতগুন। শবনম নামের সেই মেয়েটির এখন কী অবস্থা জানি না। তবে তার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন তাকে চিনির ভার বইবার শক্তি দেন। তাঁর ফুলের মতো পবিত্র মুখটায় অনাবিল হাসি লেগে থাকুক।
এভাবে ভাববিনিময় হয় কার কতদিন থেকে ডায়াবেটিস, কিভাবে হলো, এখন কি অবস্থা ইত্যাদি। এ ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ে নতুন রোগীদের মধ্যে প্রথম প্রথম যে অসম্ভব ভীতি কাজ করে তা অনেকাংশে কেটে যায়। ডায়াবেটিস রোগ ধরা পড়ার সাথে সাথে অনেক মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আর পড়াটাই স্বাভাবিক। কারণ কোনো মানুষই চায় না অসুস্থ হতে। সবাই চায় সুস্থভাবে বেঁচে থেকে জীবনটাকে উপভোগ করতে। কিন্তু যে কারণে হোক মানব শরীরে একটা না একটা রোগ বাসা বাঁধবেই। আর তখন জীবনটাকে মনে হবে অসার। মনের ভেতর বুদবুদ উঠবে অনেক কথার -উত্থিত হবে অনেক প্রশ্ন। হায় রে! জীবনটাতো তো গেল। সাধুর মিষ্টি, ইকবালের সন্দেশ, আলাদীনের রসমলাই, চর আলেকজান্ডারের দই আর তো খাওয়া যাবে না। বিয়ে বউভাত মেজবান,ওয়ালিমা সবটাতো বাদ দিতে হবে। কথাগুলো ভাবতেই আসলে কেমন যেন লাগে! একজন নতুন রোগীর মনে তাৎক্ষণিক যেসব প্রশ্নের উদ্রেক হয় তা কিন্তু শতভাগ সঠিক নয়। ডায়াবেটিস হলেই আগে যা খেতেন তার সবটাই যে খেতে পারবেন না তা মোটেই নয়। তবে খাওয়ার সময় আপনাকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে, এটাই সার কথা। আবার তাও মানবেন আপনার জন্য, জীবনের জন্য, আপনার ভালোবাসার মানুষের জন্য।
আমরা তো জীবনকে ভালোবাসি। ছোটো একটা জীবন-খুব ক্ষণস্থায়ী। অনেকটা শিশির বিন্দুর মতো। টুপ করে পড়ল আর পলকে শুকিয়ে গেল। তাই মানুষমাত্রই জীবনকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। আমরা আবার আমাদের জীবনে কাউকে না কাউকে ভালোবেসেছি মনপ্রাণ উজাড় করে। সে ভালোবাসার মানুষটি হতে পারে একজন মেয়ে, একজন বন্ধু কিংবা ভাই-বোন। তাঁদের কেউ যদি আপনাকে ভুল বুঝে দূরে সরে যায়, আপনি কী তাঁকে ভুলতে পারবেন? কক্ষনো না। ভালোবাসা এমনই। আপনাকে ক্ষুরে ক্ষুরে খাবে, আপনি তুষের আগুনে জ্বলবেন, তবু আপনি তাঁকে মন থেকে মুছতে পারবেন না। চন্ডিদাস বারো বছর বড়শি নিয়ে অপেক্ষা করেও রজকিনির সাক্ষাৎ পাননি। তাই বলে চন্ডিদাশ বড়শি গুটিয়ে নেননি। দেবদাস পার্বতীর জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নিজের জীবনটাই শেষ করে দিলেন। রাজলতক্ষী -শ্রীকান্তের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছিল বড় প্রেম, যা তাদের কাছে টানলো না দূরেই ঠেলে দিলো। জয় হলো ভালোবাসার। ডায়াবেটিসও তেমনি। আপনাকে একবার ভালোবেসেছে তো হয়েছে। আর কখনো ছাড়বে না। ভালোবেসে আপনার রক্তে থেকে যাবে চিরদিন। জীবনের সঙ্গী হয়ে।
ডায়াবেটিস কাদের হয়? কেন হয়? আমার হবে না বা আপনার হবে না -এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। অনেকের সুশৃঙ্খল জীবনাচারের জন্য প্রকাশ পেতে বিলম্বিত হতে পারে। ভালোবাসা বলে কথা। তাই যেকোনো সময় ধরা দিতে পারে-প্রেমের এ ফাঁদ পাতা ভুবনে / কখন কে ধরা পড়ে কে জানে। ডায়াবেটিসও তেমনি একটি প্রেমের ফাঁদ। সে ফাঁদে যে কেউ যেকোনো সময় পড়তে পারে। ডায়াবেটিস তাই সব বয়সী মানুষের হতে পারে। তবে সরল ব্যাখ্যায় তিন শ্রেণির মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে : ১। যাঁরা খায় বেশি পরিশ্রম করেন কম-যাঁদের উচ্চতার তুলনায় ওজন বেশি। ২। যাঁরা খায় কম বা খাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই বা যাঁদের খাবারে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থাকে। এ শ্রেণির ডায়াবেটিস ধরা পড়ে ত্রিশ বছরের কম বয়সে। এ শ্রেণির মানুষেরা ক্ষীণকায় হয়ে থাকে এবং এদের শরীরে অপুষ্টির চিহ্ন বিদ্যমান থাকে। ৩। যাঁদের পরিবারে কারো না কারো ডায়াবেটিস ছিল, বিশেষত মা ও বাবার। কখন আপনার ডায়াবেটিস হয়েছে বা হতে পারে বলে মনে করা যেতে পারে। যদি আপনার-১। ঘন ঘন প্রসাব হয়, ২। খাওয়ার পরও বেশি ক্ষুধা লাগে, ৩। বেশি পানির পিপাসা লাগে বা গলা শুকিয়ে যায়, ৪। ঠিকমতো খাওয়ার পরও ওজন কমে যায়, ৫। অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, ৬। শরীরের কোথাও কাটা গেলে তা শুকাতে দেরি হয়, ৭। শরীরে নানা চর্মরোগ দেখা দেওয়া ও তা না সারা ও ৮। চোখে কম দেখা। তবে বয়স্ক মানুষের এসব লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে।
উপর্যুক্ত লক্ষণগুলোর কোনোটা বা একাধিক লক্ষণ থাকলে রোগটি আপনার শরীরে বাসা বাঁধছে কিনা জেনে নিতে আপনাকে যেতে হবে পাশের ডায়াবেটিস হাসপাতালে। অথবা সরকারি কোনো হাসপাতালে। করাতে হবে রক্তের চিনির পরীক্ষা। এ জন্য আপনাকে খালি পেটে একবার, খাওয়ার দু’ঘণ্টা পরে একবার রক্ত দিতে হবে। “একজন সুস্থ লোকের রক্তের প্লাজমায়(রক্ত রস) খালি পেটে গ্লুকোজ এর পরিমাণ ৬.৪ মিলি মোলের কম এবং খাবার দু’ঘণ্টা পর ৭.৮ মিলি মোলের কম থাকে। এ সীমার মধ্যে থাকা মানে আপনার শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বাঁধেনি। অভুক্ত অবস্থায় গ্লুকোজের পরিমাণ ৭.৮ মিলি মোল বা তার বেশি হলে অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দু’ঘণ্টা পর গ্লুকোজের পরিমাণ ১১.১ মিলি মোল বা তার বেশি হলে ডায়াবেটিস সনাক্ত করা যায়।” (উৎস- গাইড বই, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি, পৃষ্ঠা-০৪)
ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ-ভালোবাসার রোগ। তবে ছোঁয়াচে বা সংক্রামক কোনো রোগ নয়। কোনো কারণে যদি আপনার শরীরে এই রোগ বাসা বাঁধে তাহলে মোটেই ঘাবড়াবেন না। ভালোবাসুন নিজেকে। ভালোবাসুন মানুষকে। এ রোগ কিন্তু আপনার একার নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ৭১ লক্ষ, যা প্রতি বছর বাড়ছে ১ লক্ষ করে। আর বিশ্বে এই সংখ্যা ৪১ কোটি। (উৎস-দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৩ জুন, ২০১৯)। সুতরাং ডায়াবেটিক রোগ নিয়ে চিন্তার সাগরে না ডুবে কিভাবে ভালো থাকা যাবে সেটাই মাথায় রাখুন। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার প্রধান চিকিৎসা স্বাস্থ্যশিক্ষা বা সচেতনতা। যথাযথ স্বাস্থ্য শিক্ষা পেলে একজন ডায়াবেটিক রোগী চিকিৎসকের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে এ রোগ ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। তার জন্য আপনাকে অন্তত তিনটি বিষয় মনে রাখতে হবে। নিয়মিত ও পরিমাণমতো সুষম খাবার খাওয়া, নিয়মিত ও পরিমাণমতো ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করা, চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র মেনে চলা। তবে ডায়াবেটিস রোগের সবচেয়ে কার্যকর মেডিসিন হচ্ছে হাঁটা। তবে তা দুপুরে কিংবা গরম আবহাওয়ার মধ্যে নয়। একজন ডায়াবেটিক রোগীর হাঁটার উত্তম সময় সকালে এবং বিকালে। আসুন, প্রতিদিন হাঁটি, অন্যকেও হাঁটতে বলি। মনে রাখতে হবে আপনি যতই মেডিসিন খান কিংবা ইনসুলিন নিন যদি না হাঁটেন তা কখনো পুরোপুরি ফল দেবে না। তখন ভালোবাসা আর ভালোবাসার জায়গায় থাকবে না কখন যে বিরহে পরিণত হয়েছে বুঝতেই পারবেন না।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক