ভারত হয়ে সিলেট সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসছে

23

সিলেট সীমান্ত এলাকার অরক্ষিত চোরাই পথ দিয়ে অবাধে ঢুকছে ইয়াবা, বিদেশি মদ, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকের চালান। পরে সিলেট থেকে এসব ইয়াবার চালান ট্রেন ও প্রাইভেট যানবাহনে করে পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। মিয়ানমার থেকে ভারতের মিজোরাম হয়ে সিলেটে ইয়াবার বড় চালান আসার তথ্যও রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোযোগ এড়াতে এবং সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারীদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিতে মাদক ব্যবসায়ীরা নতুন পথ হিসেবে এই অঞ্চলকে বেছে নিয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
এদিকে বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা চোরাচালানের বিষয়ে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’কে অবহিত করা হলেও তারা বিজিবিকে জানিয়েছে, তাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই।
সিলেটের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ছয়টি ভারত সীমান্তঘেঁষা। জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, জৈন্তা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলা সীমান্তের ওপর অবস্থান করছে। এই উপজেলাগুলোর পাহাড়ঘেরা বিভিন্ন চোরাই পথ ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীরা ভারত থেকে প্রতিনিয়িত নিয়ে আসছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, ভারতীয় নিষিদ্ধ সিগারেটসহ নানা ধরনের চোরাই পণ্য। তবে মাদক চোরাচালানের বেশি খবর পাওয়া যাচ্ছে জকিগঞ্জ উপজেলায়। জেলা পুলিশের অন্যান্য থানার চেয়ে এই থানাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিও বেশি। এই থানায় মাদকের মামলাও বেশি দায়ের হচ্ছে।
গত আগস্ট মাসে জকিগঞ্জ থানার হিসেব অনুযায়ী দুই জন মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। ২৯ আগস্ট জকিগঞ্জের ১০ জন বাসিন্দা র‌্যাব ও পুলিশের পৃথক অভিযানে অভিযানে ৮৬২ পিস ইয়াবাসহ এবং বড়লেখার সাদিক আহমদ নামের আরেকজন ভারতীয় ৭০ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে জকিগঞ্জের আব্দুল মান্নান ওরফে মুন্না নামের একজনের বিরুদ্ধে মাদকের ছয়টি মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর জকিগঞ্জ থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৮০০ পিস ইয়াবাসহ সুলতানপুর গ্রামের শফিক আহমদ ও একই উপজেলার নানোগ্রামের ইয়াহিয়া আহমদকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও ওই মাসে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় নিষিদ্ধ বিড়িসহ গ্রেফতার হন দুই জন এবং জাল টাকাসহ গ্রেফতার হন আরও একজন।
গত বছরের ১০ নভেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জের মানিকপুর সেনাপতির চক থেকে বিজিবি অভিযান চালিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৬১ হাজার ৪শ’ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত ইয়াবার মূল্য ছিল প্রায় এক কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার ৫৪ কিলোমিটারের সীমান্ত এলাকা। ভারতীয় অংশে পুরো সীমান্তেই কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অংশে তেমন কোনও সুরক্ষা প্রাচীর নেই। এই দীর্ঘ সীমান্ত এলাকায় দুই দেশকে বিভক্ত করেছে কুশিয়ারা আর সুরমা নদী। সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের হেঁটে টহল দিতে হয়। মিয়ানমার থেকে ভারতের মণিপুর, ইম্ফল ও শিলচর হয়ে ইয়াবার চালান দেশটির করিমগঞ্জে আসে। করিমগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর ইয়াবার একটি কারখানা রয়েছে বলে গোপন সূত্র জানায়।
সিলেট র‌্যাব সদর দফতর থেকে জানা যায়, চলতি বছরের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে র‌্যাবের অভিযানে ২২ হাজার ৯৭৩ পিস ইয়াবা, ১৪৭৭ বোতল ফেনসিডিল, প্রায় ৩৯ কেজি গাঁজা, হোরোইন ৮১.৮ গ্রাম, বিদেশি মদ ৫৮৭ লিটার ও দেশি মদ ৪৩৮ লিটার উদ্ধার করা হয়।
সিলেট বিজিবির সেক্টর কমান্ডার এ এস এম খাইরুর কবির জানান, ‘মাদকের ব্যাপারে বিজিবি সর্তক অবস্থায় রয়েছে। ইয়াবা বহন করতে সহজ হওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা এই ব্যবসায় জড়িত হচ্ছে। বিজিবি ইতোমধ্যে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করেছে। আগে এই ব্যবসায় কারা ছিল, বর্তমানে কারা এ ব্যবসায় জড়িত সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, ‘মিয়ানমার থেকে ভারতের মিজোরাম হয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের পথ ব্যবহার করে বাংলাদেশে ইয়াবা আসছে বলে বিজিবির কাছে তথ্য রয়েছে। ভারতে ইয়াবার কারখানা রয়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা তথ্য পেয়ে এবিষয়ে শিলচর বিএসএফ সেক্টরের সঙ্গে কথা বলি। এমনকি ভারতের করিমগঞ্জের আব্দুল্লাহপুরে ইয়াবার কারখানা সম্পর্কে তাদের অবহিত করি। তবে তারা জানিয়েছে, তাদের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই।’
মাদকবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিলেট জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ‘সিলেটের সীমান্ত পথ দিয়ে সবচেয়ে বেশি আসছে ইয়াবা। কারণ এটি বহন করতে সুবিধা। কিন্তু সীমান্তে নিরাপত্তা ভেঙে কীভাবে এগুলো প্রবেশ করছে সেটা ভাবার বিষয়। সীমান্তে নিরাপত্তায় গলদ রয়েছে কিনা, তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে কিনা সেই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে।’
সিলেট মাদকবিরোধী সেলের পরিদর্শক সজল কুমার কান জানান, ‘জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে মাদকবিরোধী সেলের অভিযান জেলা পুলিশের আওতাধীন বিভিন্ন থানায় মামলায় হয়েছে ২১১টি। এর মধ্যে শুধু জকিগঞ্জ থানায় মাদক আইনে এই তিন মাসে মামলা হয়েছে ২১টি। মাদক নির্মূলের জন্য পুলিশ সবসময় আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’
সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা ও গণমাধ্যম) মো. আমিনুল ইসলাম জানান, ‘মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অবস্থান একেবারে জিরো টলারেন্স। মাদক ব্যবসায়ী যতই ক্ষমতাশলী হোক না কেন তাদের কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। এজন্য জেলার প্রতিটি থানা পুলিশকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে।’
সিলেটে জকিগঞ্জ থানার ওসি আবু নাসের জানান, ‘পুরনো ও বর্তমান তালিকা অনুযায়ী পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এমনকি পুলিশ প্রতিটি ইউনিয়নে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। গত আগস্ট মাসে জকিগঞ্জ থানা পুলিশ ১১ জন মাদক ব্যবসায়ীকে ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার করেছে। তবে আগের তুলনায় এই থানাধীন এলাকায় এখন মাদক ব্যবসা অনেকটাই কমে গেছে।’