ভারত ও বাংলাদেশের সামনের দিনগুলি

152

সাম্প্রতিককালে আমেরিকার নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভার ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখ একটি বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। বৈঠকটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে জানা যায়। বৈঠকে শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বৈঠকে আশ্বস্ত করছেন যে আসামের বিতর্কিত নাগরিক পঞ্জি বা এন.আর.সি. নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ নাগরিক পঞ্জি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু একই দিনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বৈঠক সম্পর্কিত যে বিবৃতি দেওয়া হয় তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করার ব্যাপারে বা নাগরিক পঞ্জি সম্পর্কে ও ঘুণাক্ষরেও কোন কথা উল্লেখ করা হয় নাই। ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একটি পরিষ্কার আশ্বাস অন্য একটি বন্ধুপ্রতীম দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়কে দেওয়ার পর উহা বৈঠক সংক্রান্ত বিবৃতিতে উল্লেখ থাকবেনা তা কেমন করে সম্ভব? ভারতের বিশ্ব স্বীকৃত কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আমলারা এই পর্যায়ের ভুল করবেন তা হতে পারেনা। প্রধানমন্ত্রী মুদিজির কেবিনেটের স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্যদের বক্তব্য থেকে বুঝা যায় এই ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে বিরাট মতপার্থক্য রয়েছে অথবা সমঝোতার মাধ্যমে মতপার্থক্য দেখিয়ে ক‚টনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। ভারতের স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার যে নাগরিকত্ব প্রশ্নে অভিযান জোরালোভাবে আরম্ভ করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নাগরিকত্ব যারা প্রমাণ করতে পারবেনা তাদেরকে কোথায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে সে জায়গার নাম উল্লেখ করতে অমিত শাহ কোন দ্বিধা করছেন না। অমিত শাহের কথার সাথে প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শঙ্করের বার বার বাংলাদেশকে দেওয়া আশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে না। হরিয়ানায় আসন্ন বিধান সভার নির্বাচন উপলক্ষ্যে এক জনসভা থেকে স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বলেন ২০২৪ সালে আমরা দেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের উৎখাত করে তাদের দেশে ফেরত পাঠাব। তিনি আরো বলেন ৭০ বছর ধরে এই অনুপ্রবেশকারীরাই আপনাদের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন আপনারা কংগেসকে জিজ্ঞাসা করুন তারা কেন এন.আর.সির বিরোধিতা করছে, তারা কেন জম্বু কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ও ৩৫ এ ধারা প্রত্যাহার এবং তিন তালাক প্রথা বিলোপের বিরোধিতা করছে?
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেছেন এবং কিছু দ্বিপাক্ষিক চুক্তি দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই সব চুক্তির মধ্যে বাংলাদেশের জন্য যেসব চুক্তির প্রয়োজন তার একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয় নাই। তারপরও উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দু’দেশে বন্ধুত্ব উচ্চতম স্তরে বিরাজ করছে। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয়। অথচ সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উঠেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বর্বরতম গণহত্যা চালিয়েছে। বিশ্বের প্রত্যেক দেশের কাছে এবং মানবতাবিরোধী সংস্থাগুলির কাছে এই বর্বরতার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে এবং সমস্ত কিছু বিশ্বের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে যখন এই ব্যাপারে আলোচনা অনুষ্ঠিত হলো, বিশ্বের ৩৭ টি দেশ এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু ভারত এবং চীন সমর্থন জানান নাই। বাংলাদেশের মানুষ চীনের বিরোধিতা সহ্য করতে পারে। কিন্তু ভারতের বিরোধীতা কেমন করে সহ্য করতে পারে? কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা উভয় দেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত।

 
প্রায় ১৯ লক্ষের মতো বাংলাভাষী হিন্দু এবং মুসলমান আসামের নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়েছে। তাতে পশ্চিম বঙ্গের মানুষের মধ্যে চরম আতংক সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী জানিয়েছেন এই পর্যন্ত নাগরিকত্ব প্রমাণের পুরানো দলিলাদি সংগ্রহ করতে গিয়ে উদ্বেগ এবং উৎকন্ঠায় ৬ জন লোক প্রাণ হারিয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী নাগরিকত্বের প্রমাণের দলিলাদি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে বেশ কিছু লোক আত্মহত্যা করেছে। অবশ্য মমতা বার বার আশ্বাস দিচ্ছেন যে তিনি যতদিন ক্ষমতায় আছেন নাগরিক পঞ্জি পশ্চিম বঙ্গে হতে দেবেন না। কিন্তু তাঁর এই কথায় পশ্চিম বঙ্গে মানুষ আস্থা রাখতে পারছেন না। কারণ দিল্লীতে মমতা ব্যনার্জীর সাথে এই ব্যাপারে অমিত শাহের দীর্ঘ আলাপের পর অমিত শাহ কলকাতায় এসে তিনি নিজেই বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেছেন, ‘শুধু পশ্চিম বঙ্গে না ভারতের প্রত্যেক রাজ্যেই নাগরিক পঞ্জি হবেই এবং যারা নাগরিক পঞ্জির বাইরে থাকবে তাদেরকে অবশ্যই ভারত থেকে বের করে দেওয়া হবে এবং তাদের গন্তব্যস্থান যে বাংলাদেশেই হবে তা তিনি এই পর্যন্ত কয়েকবার উল্লেখ করেছেন।’ ইহা ছাড়াও বি.জে.পির সর্বভারতীয় জেনারেল সেক্রেটারী কৈলাশ বাবুও পশ্চিম বঙ্গে নাগরিক পঞ্জির কথা সুনিশ্চিত করেছেন। অবশ্য ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের সেক্রেটারী জেনারেল পার্থ চট্টপাধ্যায় বলেছেন বি.জে.পি. যদি সত্যিই হিন্দুদের স্বার্থে নাগরিক পঞ্জি করে থাকেন তাহলে আসামে যেসব হিন্দুদের নাম নাগরিক পঞ্জিতে নাই তাদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়া হউক। অথচ আসামের জনগণ ইহা কিছুতেই মানবেনা। কারণ আসামিরা ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিক পঞ্জির পক্ষে নয়। তাদের দাবি হলো যে ধর্মেরই লোক হউক না কেন এদেরকে আসাম থেকে চিরতরে বের করে দিতে হবে।
আসামের ব্যাপারে বি.জে.পি. বতর্মানে উভয় সংকটে রয়েছে। আসামের এই সংকটের কথা টের পেয়ে সংঘ পরিবার বি.জে.পি; আর.এস.এস. এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আসামের ঘটনা থেকে শিক্ষা পেয়ে প্রচার করছে। তারা লোক সভায় নাগরিক বিলে সংশোধনী আনবে এবং যাদের নাগরিকত্ব পাওয়া যাবেনা তাদের মধ্য থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, পারসি, জৈন এবং শিখদেরকে নাগরিকত্ব দিয়ে নাগরিক বিল পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে নিবে। এর অর্থ হলো শুধু মুসলমানদেরকে ঐ সংশোধনী থেকে বাদ দেওয়া হবে। দুভার্গ্যবশতঃ এই কাজটা যদি করা হয় তাহলে সারা বিশ্বে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে যে বৈরী প্রতিক্রিয়া হবে তাতে ভারত অর্থনৈতিক দিয়ে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে বারে বারে প্রথিত যশা রাজনীতিবিদরাই ভুল করেছেন। এক কালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন হিন্দু মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত। আবার দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে তাঁর নেতৃত্বে ভারতবর্ষ দ্বিখÐিত হল। পাকিস্তান হওয়ার পর যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তাঁকে জেয়ারত নামক পাহাড়ী অঞ্চলে চিকিৎসার নামে ফেলে রাখা হল তখরই তিনি বুঝতে পারলেন জীবনে তিনি ভীষণ ভুল করে ফেলেছেন। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লেয়াকত আলী খাঁন তাঁকে যখন দেখতে গেলেন তখন রেগে গিয়ে জিন্নাহ তাঁর ভুলের কথা বললেন। লিয়াকত আলী বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে জিন্নাহকে রেখে বের হয়ে গেলেন। তারপর তিনি হেসে বললেন, ‘বৃদ্ধ এখন বুঝতে পেরেছেন যে তিনি ভুল করেছেন।’ তারপর তিনি জোরে হাসলেন এবং চলে এলেন। এর কয়েক দিনের মধ্যেই জিন্নাহর মৃত্যু হয়।
পাক-ভারত এবং বাংলার সাধারণ মানুষের রাজনীতিবিদদের প্রতি সনির্বদ্ধ অনুরোধ আপনাদের ভুলের মাশুল দিতে দিতে সাধারণ মানুষ রিক্ত, বিরক্ত এবং তিক্ত হয়ে গেছে, এবার তাদেরকে ক্ষমা করেন। আসলে আসামের ১৯৮০ দশকের আন্দোলনটা ছিল আসামের আদি বাসিন্দাদের রেখে অ-আসামিদের আসাম প্রদেশ থেকে বের করে দেওয়ার আন্দোলন। এখানে হিন্দু মুসলমান বা বাঙালি আসামিদেরকে নিয়ে কোন প্রশ্নই ছিলনা। এখন বি.জে.পি; আর.এস.এস. এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এনআরসি থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে বাদ দেওয়ার প্রশ্ন তুলে একটা হ-য-ব-র-ল এর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। আসামের অধিবাসীরা হিন্দুত্ববাদীদের এসব কূটকৌশল ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরে তাদের সাথে রাজনৈতিক ঐক্যের সাঙ্গ করেছেন।
গত সাড়ে পাঁচ বৎসরব্যাপী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আছে। তার হিন্দুত্ব কায়েম, গো হত্যা বন্ধ, রাম মন্দির তৈয়ার করা, মানুষের নিরাপত্তা লÐভÐ করে গরুকে নিরাপত্তা দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে এত বেশি সময় ব্যয় করেছে যে জাতীয় জরুরি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়ার সময় তাঁরা পান নাই। ফলে গত ৪৫ বৎসরের মধ্যে সবচাইকে বেশী সংখ্যক বেকারের সৃষ্টি হয়েছে। সবচাইতে উদ্বেগের বিষয় হলো যুব সম্প্রদায়ের মধ্যেই বেশী বেকার সৃষ্টি হয়েছে। ইহার অর্থ দাঁড়ায় ভারতে সবচাইতে বেশি আইন-শৃংখলার সমস্যা অচিরেই দেখা দিবে। ভারতের সমগ্র কৃষিখাতে কৃষিঋণের সৃদের টাকা শোধ করতে না পেরে কৃষকের আত্মহতা করা নিত্য নৈমত্তিক ঘটনায় রুপ নিয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে এবং শিল্পক্ষেত্রেও উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। গাড়ি সহ অনেক পণ্যের উৎপাদন চাহিদার অভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এতদিন ভারতীয়সরকার ৭ শতাংশ এবং ৮ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের বড় বড় অর্থনীতিবিদরা সম্প্রতি পুংখানুপুংখ হিসাব করে সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দিয়েছেন যে কোন অবস্থাতেই ভারতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৫% শতাংশের বেশি হয় নাই। এখন সংশ্লিষ্টরা চুপ হয়ে গেছেন। অর্থাৎ ৫ শতাংশ উৎপাদনের কথাই শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন।

লেখক : কলামিস্ট