ভারতে কংগ্রেস এর পুনঃউত্থান

199

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির কাছে পরাজয়ের পর থেকে উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছিল ভারতের রাজনীতিতে। লোকসভার পরই ক্রমান্বয়ে বেশকয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতা হারায় কংগ্রেস। যেসব রাজ্যে বিজেপি জয়লাভ করতে ব্যর্থ হয় সেসব রাজ্যেও ক্ষমতায় আসে আঞ্চলিক দলগুলি। যেমন দিল্লি, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবাংলা। সা¤প্রদায়িকতা, গো রক্ষার নামে নির্যাতন ও হত্যা এবং আর্থিক দুর্নীতির জন্য দ্রুতই বিজেপির জনপ্রিয়তা কমতে থাকলেও কংগ্রেস সেই সুবিধা নিতে পারেনি। অন্যদিকে বিজেপি অনেক রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হয়েও কেন্দ্রীয় সরকারের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক দলগুলির সাথে জোট করে ক্ষমতা দখল করে। যেমন গোয়া ও মনিপুর এ বিধানসভায় কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েও বিজেপি জোট সরকার গঠন করে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকায় বিজেপি আঞ্চলিক দলগুলিকে যে সুবিধা দিয়ে জোটে নিতে পেরেছিল সেটা কংগ্রেস এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তরুণ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী কংগ্রেস এর নেতৃত্ব নেওয়ার পর খুব বেশি সাফল্য দেখা যাচ্ছিল না। প্রথম বড় কোন রাজ্যে কংগ্রেস সাফল্য পায় গত বছর পাঞ্জাবে সরকার গঠন করতে পেরে। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরেই পাঞ্জাবে বিজেপি সরকার ছিল শিখদের শিরোমনি আকালি দলের সমর্থনে। কিন্তু ২০১৭ সালে এই প্রদেশে কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে অমরেন্দ্র সিং এর নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে পারে। তবে একই সময়ে উত্তর প্রদেশে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বিহারেও বিজেপি বিরোধি লালু প্রসাদ যাদব ও নিতিশ কুমার এর জোট ভাঙ্গতে সক্ষম হয় বিজেপি এবং পুরান জোট সঙ্গি নিতিশ এর সাথে জোট করে বিহারের ক্ষমতায় ভাগ বসাতে সক্ষম হয়। উত্তর পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের প্রত্যেকটিতেই বর্তমানে ক্ষমতার অংশিদার বিজেপি। সবশেষ মিজোরাম এ কংগ্রেস সরকারকে কেন্দ্রের জোটসঙ্গি মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবারের নির্বাচনে পরাজিত করেছে। তবে মিজোরাম এ এমএনএফ একাই সরকার গঠন করতে পারবে। অন্য ছয়টি রাজ্যেই বিজেপি স্থানীয় দলগুলির সাথে জোট করে ক্ষমতায় আছে।
যখন মনে হচ্ছিল সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেস গুরুত্ব হারাচ্ছে তখনই রাহুল গান্ধী কংগ্রেস এর সাধারণভাবে বিভিন্ন রাজ্যে একক দল হিসেবে নির্বাচন করার বদলে অন্যান্য দল এর সাথে ঐক্যজোট অথবা নির্বাচনী সমঝোতা করার পথ বেছে নেন। তার এই নীতি উত্তর প্রদেশে বিশেষ সাফল্য লাভ না করলেও তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটি অন্যান্য অঞ্চলের আঞ্চলিক নেতাদের আকৃষ্ট করে। যেসব জায়গায় কংগ্রেস এককভাবে নির্বাচনে সাফল্য লাভে সক্ষম হবেনা বলে মনে করা হয়েছে রাহুল গান্ধী সেসব জায়গায় বিজেপি বিরোধী যেকোন দল এর সাথে জোট বা সমঝোতা করতে প্রস্তুত এই বার্তা দেন। যার একটি ছিল অন্ধ্র প্রদেশ এর তেলেগু দেশম পার্টি। এর নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু দীর্ঘদিন বিজেপির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সা¤প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদির সাথে তার মতপার্থক্য হয়। রাহুল পুরাতন সংঘাত ভুলে গিয়ে নাইডুর টিডিএম এর সাথে নির্বাচনি ঐক্য গড়েন সাবে অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে তৈরি করা তেলেঙ্গনাতে। যদিও নির্বাচনে এই জোট কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি। কিন্তু এই জোট কংগ্রেসকে অন্য সুবিধা দেবে। তেলেঙ্গনায় বিজয়ী টিআরএস বা তেলেঙ্গনা রাষ্ট্রিয় সমিতি টিডিপি থেকেই ভেঙে তৈরি দল এবং তারা বিজেপির বিরোধী। রাজ্য সরকার গঠনে ব্যর্থ হলেও টিআরএস এর বিজয় ২০১৯ সালের অনুষ্ঠিতব্য লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে সুবিধা দেবে।

লোকসভা নির্বাচনের আগে শেষ বড় কোন বিধানসভা নির্বাচনে দুটি গুরুত্বপ‚র্ণ রাজ্য রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে কংগ্রেস। রাজস্থানে দীর্ঘ দিনের বিজেপি সরকারকে পরাজিত করে বিধানসভায় নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে সচিন পাইলট ও অশোক গহলত এর নেতৃত্বাধিন কংগ্রেস। এখানে তারা অন্য কোন দল এর উপর নির্ভরশীল নয় সরকার গঠনে। মধ্যপ্রদেশেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১১৬ টি আসন বিধান সভায় লাভ করেছে কংগ্রেস। উল্লেখযোগ্য ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজস্থান এর সবকটি আসনে বিজেপি জয় পেয়েছিল এবং মধ্যপ্রদেশের অধিকাংশ আসনেও বিজেপি বিজয়ী ছিল। আরেকটি ছোট রাজ্য ছত্তিসগড়েও কংগ্রেস একক দল হিসেবে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। জনজাতি অধ্যুষিত এই রাজ্যে মাওবাদী গেরিলাদের প্রভাব রয়েছে।
বিজেপির মূল শক্তি বা সাপোর্ট বেজ হিসেবে ধরা হয় উচ্চবর্ণের হিন্দু স¤প্রদায় অধ্যুষিত হিন্দিভাষি অঞ্চল কে। যার অন্তর্ভুক্ত রাজস্থান থেকে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল এবং দক্ষিণ এর মহারাষ্ট্র। এই অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে বিজেপি বরাবরই সাফল্য লাভ করেছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপি প্রথম একটি হালকা ধাক্কা খায় দিল্লির নির্বাচনে। রাজ্য হিসেবে ছোট এবং অন্যান্য রাজ্য থেকে কম ক্ষমতাশালী হলেও রাজধানী হওয়ায় এর গুরুত্ব যথেষ্ট। প্রায় হঠাৎ করে জন্ম নেওয়া কোন পুরাতন রাজনীতিবিদবিহীন এই আম আদমি পার্টি বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়কে পরাজিত করে দিল্লি বিধান সভার প্রায় সকল আসন দখল করে। এরপর উত্তরপ্রদেশ,উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা ও হীমাচল প্রদেশে বিজেপি সাফল্য লাভ করলেও প্রথম ধাক্কা খায় পাঞ্জাবে। এবার রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশ এর পরাজায় বিজেপিকে আগামী বছর এর লোকসভা নির্বাচনে যথেষ্ট চিন্তায় ফেলবে সেটা নিশ্চিত।
বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস সরকারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে। এ বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ভারতে প্রচলিত ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট হঠাৎ বাতিল করেন। বলা হয় এর ফলে কালো টাকা উদ্ধার হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল প্রচলিত নোট এর ৯৯% ই ফিরে এসেছে ট্রেজারিতে। এই নোট বাতিলের ফলে খুচরা ব্যবসা যে সমস্যার মধ্যে পড়েছিল তিন বছরেও তার ক্ষতিপূরণ হয়নি। মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান এ বিজেপির পরাজয়ের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল কৃষি বিপর্যয়। এই রাজ্যগুলিতে গত কয়েকবছর ভাল ফসল উৎপাদন হওয়া সত্তে¡ও ন্যায্যদাম না পাওয়ায় কৃষিঋণ এর ফাঁদে পড়ে অনেক কৃষক আত্মহত্যা করেছে। আর যে বিষয়টি প্রভাবিত করেছে তা হল সা¤প্রদায়িকতা। বিজেপি সরকার এর সময় গো-রক্ষকদের আচরণ সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। রাজস্থানে গো রক্ষার নামে শুধু মুসলিমই নয় নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের উপরও অনেক অত্যাচার ঘটেছে। লাভ জিহাদের নামে পশ্চিম বাংলার দরিদ্র দিনমজুর আফরাজুল এর হত্যা এবং সেই হত্যার বিষয়ে রাজস্থান সরকারের গা-ছাড়া মনোভাব যে শিক্ষিত তরুণদের প্রভাবিত করেছে তা নিঃসন্দেহ।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি সবসময়ই প্রাধান্য পায় তার কাছে। গণতান্ত্রিক সরকারকে তাই সেগুলি পূরণ বেশি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সেটা ভুলে গিয়ে বিজেপি এই নির্বাচনে হিন্দুত্ব, গো-রক্ষা ও রামমন্দির কে ইস্যু করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই বিষয়গুলিকে মানুষ ভালভাবে গ্রহণ করেনি। উত্তর প্রদেশের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথকে এই রাজ্যগুলিতে প্রচারণা পাঠিয়ে বিজেপির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। যোগি আদিত্য হিন্দুত্বকে তুলে ধরতে তেলেঙ্গনায় হায়দারাবাদ শহর এর নাম ভাগ্যনগর করার দাবি তুলেন। অন্য রাজ্যগুলিতেও দেখা যায় তিনি যেসব কেন্দ্রে হিন্দুত্বের কথা বলে প্রচার চালিয়েছেন সেখানে বিজেপি খারাপ ফলাফল করেছে। এই ফলাফল নিকটবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগে হিন্দুত্ব বা দেশপ্রেম এ জাতীয় সেøাগান এর বদলে বিজেপিকে নতুন কোন জনকল্যাণমূলক নীতি নিতে বাধ্য করবে। অন্যদিকে গত পাঁচবছর থেকে প্রভাব হারাতে থাকা কংগ্রেস হারানো প্রভাব ফিরে পেতে নতুন উদ্দাম দেবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক