ভারতের স্বীকৃতি ‘বাংলাদেশ স্বাধীন’

95

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর দিনটি ছিল সোমবার। একাত্তরের এদিন রণাঙ্গনের অবস্থা আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হানাদার বাহিনী সূর্য ওঠার আগেই বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পালাতে থাকে। ভারত স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির সময় ভারত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। সেদিন লোকসভায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, মি: চেয়ারম্যান, অকল্পনীয় বাধার বিপরীতে বাংলাদেশের জনগনের সাহসী যুদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সাহসিকতার একটি নতুন অধ্যায়ের সুচনা করেছে। এর আগে তারা গনতান্ত্রিক বিজয়ের এক নমুনা রেখেছে নির্বাচনের মাধ্যমে এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন। আমরা কখনই জানতে পারব না কিভাবে এই বাস্তবসম্মত ও মহান অনুভুতি, যদি আসলেই তা থেকে থাকতো, বদলে গেল প্রতারণা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশে। আমাদের জানা ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল, আওয়ামী লীগ, পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তারা সম্পূর্ন অপ্রস্তুত অবস্থায় ভয়ঙ্কর সামরিক আক্রমনের মুখে পড়েছে। এই অবস্থায় স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিফৌজ, যা পরিণত হয় মুক্তিবাহিনীতে, যাদের সাথে যোগ দেয় পূর্ব বাংলার হাজার হাজার মুক্তিপাগল তরুন যারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়তে চেয়েছিল। যে একতা, একাগ্রতা ও সাহসের সাথে বাংলাদেশের জনগন লড়ে যাচ্ছে তা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলো তুলে ধরেছে। পাশের দেশের এসব ঘটনা এবং এর ফলে তৈরি সীমান্ত পার হয়ে আসা শরনার্থীদের ঢল আমাদের দেশের উপর সুদূরপ্রসারী ছাপ রাখবে নিঃসন্দেহে। এটাই স্বাভাবিক ছিল যে আমাদের সহানুভুতি থাকবে ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবীতে সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগনের দিকে। কিন্তু তাদের স্বীকৃতির ব্যাপারে আমরা কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেইনি, আমাদের সিদ্ধান্তগুলো স্রেফ আবেগের বশে নেয়া নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যত বাস্তবতার পর্যালোচনার মাধ্যমে নেয়া। বাংলাদেশের জনগনের একাট্টা হয়ে ফুঁসে ওঠা এবং তাদের সংগ্রামের সাফল্যই পরিস্কার ভাবে বলে দিচ্ছে যে তথাকথিত মাতৃরাস্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সম্পূর্ন অক্ষম। আর বাংলাদেশের সরকারের আইনগত বৈধতার প্রসঙ্গে এখন সারা দুনিয়া জানে যে এতে সারা বাংলাদেশের জনমতের প্রতিফলন আছে, যা কিনা অনেক দেশের সরকারই দাবী করতে পারে না। গভর্ণর মরিসের প্রতি জেফারসনের বিখ্যাত উক্তির মত বলতে হয়, বাংলাদেশের সরকার “জনগনের পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত মতামত” এর মাধ্যমেই সমর্থিত। একথা ধরে নিলে, পাকিস্তানের সামরিক শাসক, যাদেরকে রক্ষা করার জন্য কিছু দেশ উদগ্রীব, কোনভাবেই তাদের জনগণকে, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকেও প্রতিনিধিত্ব করে না। এখন যেহেতু পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাই শান্তিপূর্ন সমাধানের আশায় আমাদের ধৈর্য ধরা, যা না করলে কেউ বলতে পারে যে আমরা হস্তক্ষেপ করছি, এই ধৈয্যের কোন মানে আর নেই। বাংলাদেশের জনগন, যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে যুদ্ধ করছে এবং ভারতের জনগন যারা শত্রæর আক্রমন থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার যুদ্ধ করছে, এখন একসাথে, একই লক্ষ্যে কাজ করছে। আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানা”িছ যে, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশের সরকারের পূনঃ পূনঃ অনুরোধের ভিত্তিতে ভারতের সরকার, সকল বিষয় ভেবে চিনতে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের আশা আছে যে সময়ের সাথে সাথে আরো অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং অতি শীঘ্রই বাংলাদেশ পরিপূর্ন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। এই সময়ে আমরা স্মরণ করছি এই নতুন দেশের জন্মদাতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমি নিশ্চিত যে এই রাজ্যসভা চাইবে যাতে আমি অবিলম্বে বাংলাদেশের মাননীয় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে এবং তাদের সহযোগীদেরকে আমাদের উষ্ণ অভিনন্দন জানাই। আমি এই সভাতে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে পাওয়া তথ্য পেশ করছি। সন্মানিত সদস্যরা জেনে খুশি হবেন যে, বাংলাদেশ সরকার তাদের দেশ পরিচালনার মূলমন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্রে, ধর্মনিরেপক্ষতা, এবং এমন একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ন বা লিঙ্গ ভেদে কোন বৈষম্য থাকবে না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে যে নীতিগত ভাবে তাঁরা জোটনিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ন সহাবস্থানের পক্ষে, এবং সব ধরনের ঔপনিবেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ এর বিপক্ষে। ভারত এসব ব্যাপারে নীতিগতভাবে একই অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ সরকার বারবার তাদের দেশের যেসকল জনগন আমাদের দেশে সাময়িকভাবে আশ্রয় গ্রহন করেছে তাদের ফেরত যাবার ব্যাপারে এবং তাদের সহায় সম্পত্তি তাদের কাছে ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বাত্বক সহায়তা দেব। আমি বিশ্বাস করি যে আগামীতে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার, যারা একই নীতি ও ত্যাগে বিশ্বাসী, একে অপরের সার্বভৌমতা, আঞ্চলিক সুরক্ষা, পারস্পরিক সহায়তা ও একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এভাবেই মুক্তি ও গনতন্ত্রের জন্য এক সাথে কাজ করে আমরা সুপ্রতিবেশী হবার ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে উঠব, এবং এভাবেই শুধু এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতি ও প্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রতি আমাদের শুভ কামনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যদের হর্ষধবনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধবনিতে ফেটে পড়েন তারা। স্বীকৃতি পেয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিত্ররাষ্ট্র ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ভারতের সৈন্যবাহিনী জওয়ানরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার শত্রূদের নির্মূল করার জন্য যুদ্ধ করে চলছে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় ভারতের সঙ্গে তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তান। পাক-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় উপ-নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে। এ নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর থেকে অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিলো।