ভারতের লোকসভা নির্বাচন একটি পর্যালোচনা

70

ভারত আমাদের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশি। সাত দশক ধরে ভারতে গণতন্ত্র চর্চা চলছে। বর্তমানে সেখানে সরকার পরিবর্তনের সাধারণ নির্বাচন চলছে। প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের এ দেশটির ৯০ কোটি ভোটার। গণচীনের পরই জনসংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ ভারত। যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া ও যুক্তরাজ্যের মোট ভোটারের দ্বিগুণের বেশি ভোটার রয়েছে ভারতে। দেশটিতে উন্নত উদার স্বচ্ছ ভোটাধিকার চর্চা হলে বাকি বিশ্বের গণতন্ত্র চর্চাকারীরা আশাবাদি হবেন। এর মধ্যে গণতন্ত্রের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকতাকারী যুক্তরাষ্ট্রে এমন একজন প্রেসিডেন্টকে বাছাই করা হয়েছে, যিনি একজন আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক ও উগ্র জাতীয়তাবাদী। গণতন্ত্রের চেতনা, আচার, আচরণের সাথে তার কোন মিল আছে বলে আমাদের কাছে মনে হয় না। গণতন্ত্রের নামে অনেক দেশে এখন আবির্ভূত হয়েছে স্বৈরশাসকের। গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলা ইউরোপ আমেরিকাকে গণতন্ত্রের করুণ দশা নিয়ে খুব একটা উদ্বেগ দেখাতে দেখা যাচ্ছে না।
এরপরও ভারতের মত বড় দেশ গণতন্ত্রের উন্নত চর্চার বিকাশ করতে পারলে অনেকের জন্য সেটা প্রেরণা হতে পারে। লোকসভা নির্বাচনের মওসুমে এ মূল্যায়ন দরকার। এবার ১১ এপ্রিল থেকে ২৩ মের মধ্যে সাত দফায় এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৫৪৫ আসনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১০ হাজার প্রার্থী এতে অংশগ্রহণ করছেন। নির্বাচন কমিশন এ জন্য ১০ লাখ ভোট কেন্দ্র স্থাপন করছে। দুই কোটি ৩৩ লাখ ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে। এ জন্য এক কোটি ১০ লাখ লোক নিয়োগ করতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে। ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বাস ট্রেন থেকে শুরু করে ঘোড়া ব্যবহার হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের নীতি হচ্ছে কোনো ভোটারকেই যাতে দুই কিলোমিটারের বেশি যেতে না হয় একটি ভোটের জন্য।
গত নির্বাচনে কেবল একজন ভোটারের জন্য পশ্চিম ভারতের এক বনে একটি ভোটের বুথ স্থাপন করা হয়েছিল। আরেকটি ভোটকেন্দ্র স্থাপন হয়েছিল হিমালয়ে, জায়গাটি ছিল সমুদ্র সমতল থেকে ১৫ হাজার ফুট ওপরে। একজন লেখকের গণতন্ত্র চর্চার জন্য ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের বিপুল কর্মকান্ডের আয়োজন বোঝাতে এই বিবরণ দিয়েছেন লেখক তার লেখায়। সর্বশেষ ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার ইতিবাচক দিক হচ্ছে দেশটির একটি নির্বাচন কমিশন সৃষ্টি করতে পেরেছে। ভোট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার জন্য তারা বিভিন্ন সময় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে। বরং রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের মতো কট্টর গোষ্ঠিগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দানকারী বিজেপি ক্ষমতায় এলেও জনগণের ভোট দেয়ার অধিকার সেখানে হরণ করা সম্ভব হয়নি। যদিও এর মধ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রভাবিত করার জন্য বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। রাষ্ট্রীয় অর্জনগুলোকে দলীয় অর্জন হিসেবে ভোটারদের সামনে উপস্থিত করার দৃষ্টিকটু চেষ্টাও তারা করেছে। বিজেপি গণতন্ত্র চর্চার চেয়ে এক কাজগুলোর প্রতি অনেক বেশি মনোযোগী। এ জন্য অনেকে বলতে শুরু করেছেন, আবার মোদি ক্ষমতায় আসলে ভারতে গণতন্ত্র থাকবে না।
সম্প্রতি কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে ভারত। মহাকাশে ৩০০ কিলোমিটার দূরে নিজেদের একটি উপগ্রহ এর মাধ্যমে তারা ধ্বংস করে। মহাকাশে এ ধরনের কাজ সম্পন্ন করেছে আরো তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন। চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারত এ ক্লাবের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই অর্জনকে নরেন্দ্র মোদি একান্ত ব্যক্তিগত ও দলীয় অর্জন হিসেবে ভোটের মওসুমে কাজে লাগাবেন। পরীক্ষাটি করা হলে ঠিক লেকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজের ব্যক্তিগত টুইটারে নাটকীয়ভাবে জাতীয় অর্জনের এ ঘোষণা তিনি দিলেন। সম্প্রতি মোদির টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে জানানো হয়, ১২টা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিবেন। সাড়ে ১২টায় আসা সেই ঘোষণায় মোদি বলেন, আজ দেশের জন্য এক দুর্দান্ত মুহূর্ত। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা গর্ব করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন। শুধু জলে নয়, এবার থেকে আমরা ভারতের অন্তরীক্ষকেও সুরক্ষিত করলাম।
পুলওয়ামায় আধা সামরিক বাহিনীর ২৪ জওয়ান নিহত হওয়ার পরও এই ঘটনাটিকে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক জোশ তৈরি করার কাজে ব্যবহার করেন মোদি। ওই আত্মঘাতী হামলার প্রতিশোধ নিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অভিযান (সার্জিক্যাল স্ট্রাইক) চালায়। দাবি করা হয়, অসংখ্য জঙ্গি হত্যার পাশাপাশি তাদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয় ওই অভিযানে। এর পরপরই ভারতীয় সেনাদের এক রাজনৈতিক জনসভায় এমনভাবে প্রকাশ করলেন। জওয়ান হত্যার গ্লানি মোদি ও তার দলের বিজয়ে পরিণত হলো। মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়। সর্বশেষ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানে পরিচালিত ভারতীয় বিমানবাহিনীর ওই অভিযানে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। মোদির জনপ্রিয়তায় এর মধ্যে ধস নেমেছে। রেটিংও কমে ৪৩ শতাংশে নেমে এসেছে। বিজেপি এখন নিজেদের দলের জনপ্রিয়তা নিয়েও শঙ্কায় পড়ে গেছে। নির্বাচনের মাঝপথে এসে বিজেপি তাদের প্রচারণায় ইস্যু পরিবর্তন করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু বাদ দিয়ে তারা এখন উন্নয়নকে প্রচারণার অগ্রাধিকার দিয়েছে। ১১ এপ্রিল প্রথম ধাপের নির্বাচন পরবর্তী তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তারা তাদের অবস্থানে এই পরিবর্তন এনেছে। (সূত্র আজকাল, কোলকাতা)
ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তারা প্রতিরক্ষা বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করার জন্য আহবান জানিয়ে দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি লিখেছেন। রাষ্ট্রপতি কোবিন্দকে লক্ষ্য করে চিঠিতে তারা বলেছেন, সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযান, বীর জওয়ানদের ছবি, তাদের পোশাক, প্রতীক ও বীরত্ব ও শৌর্ষ যেভাবে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে সেনাবাহিনীর কৃতিত্ব টেনে আনা হচ্ছে। তা অস্বাভাবিক, এই প্রবণতা বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্দেশ দিতে তারা রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছেন। ওই চিঠিতে ১৫৬ সাবেক সেনা কর্মকর্তার সই আছে। এ ব্যাপারটি প্রকাশ হয়ে গেছে যে, ভারতের ক্ষমতাসীন দল সেনাবাহিনীর বীরত্ব গাথাকে নিজেদের সাফল্য হিসেবে প্রচার করে নির্বাচনী সুযোগ নিতে চাইছেন।
ভারতের নির্বাচনে আরেকটি গুরুতর ব্যাপার হলো মিথ্যাচার ও চরিত্র হনন। প্রতিদ্ব›দ্বী প্রধান ব্যক্তিরা একে অপরের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ তুলছেন যা ডাহা মিথ্যা। কলকাতার সাংবাদিক শান্তনু দে বাংলাদেশি একটি পত্রিকায় লিখেছেন মিথ্যাচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিপক্ষ মানেন নরেন্দ্র মোদিকে। ৫১ মিনিটের ভাষণে মমতার অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমি মোদির মতো মিথ্যা বলিনা’ লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকে ভারতবর্ষের এই দুই প্রধান নেতা একে অপরের বিরুদ্ধে কামান দাগিয়ে চলছেন। একে অপরের বিরুদ্ধে যে কথা বলছেন সেগুলো সত্যি হলে কেউ আর দেশের রক্ষক হিসেবে থাকতে পারেন না। উভয়ে দোষী হয়ে যান। এ জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আর যদি তারা মিথ্যা বলে থাকেন, তাহলেও চরম অন্যায় অনৈতিক কাজ করছেন। একই ধরনের পাল্টাপাল্টি মিথ্যাচার চলছে মোদির সাথে কংগ্রেস প্রধান রাহুল গান্ধীসহ আঞ্চলিক বড় দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও। মোদিকে লক্ষ্য করে রাহুল বলেছেন, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। অন্যদিকে দিল্লিতে কংগ্রেসের অফিস থেকে অবৈধ অর্থকড়ির লেনদেন হয় বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন মোদি। এদিকে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চ। চৌকিদার চোর সংক্রান্ত বক্তব্যের জন্য রাহুলকে নোটিশ পাঠায়। সাথে সাথে সারেন্ডার করেন রাহুল। তিনি এটাকে রাজনৈতিক প্রচারণার উত্তেজনায় করা একটি ভুল বলে স্বীকার করে নেন। যা হোক ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচন শেষ হবে আগামী ১৯ মে। এরপর ফল ঘোষণা করা হবে ২৩ মে। নির্বাচনের ফলাফলে বিজেপিই ক্ষমতায় টিকে থাকবে নাকি কংগ্রেসের নেতৃত্বে নতুন সরকার আসবে তা নিয়ে চলছে নানা ধরনের বিচার বিশ্লেষণ। এদু’টি দলের বাইরে আবার তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটানোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার গঠন নিয়ে শীঘ্রই দিল্লিতে বৈঠকে বসবেন বিজেপি বিরোধী দলগুলোর। এর পেছনে আছে বিজেপি ও কংগ্রেস বিরোধী বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দল। এসব দলের নেতারাই কেন্দ্রে তৃতীয় শক্তির সরকার গড়ার জোর তৎপরতা শুরু করেছেন। এদের মধ্যে মূল ভ‚মিকায় আছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তাদের সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে হবেন তা এখনো বলা না গেলেও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার নাম উঠে এসেছে। উচ্চারিত হচ্ছে মায়াবতীর নামও। সূত্র আজকাল ও আনন্দবাজার পত্রিকা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এ বারের নির্বাচনে বিজেপি বা এনডিএ কেউই ‘ম্যাজিক ফিগার’ ২৭২-এ যেতে পারবে না। তবে বিজেপি নেতা রাম মাধব বলেছেন, তৃতীয় ফ্রন্ট দিবাস্বপ্ন। বিজেপি এবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও আরো একবার এনডিএ সরকার গঠন করবে। কংগ্রেস অবশ্য রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার গঠনে তৎপর। হিসাব নিকাশ করে দেশের প্রতিটি কোনায় প্রচারে ব্যস্ত রাহুল গাজী ও তার বোন প্রিয়ংকা। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেটি পরের কথা। প্রাথমিক লক্ষ্য বিজিপিকে গদি থেকে নামানো। বলে রাখা ভালো, রাহুল গান্ধী আগেই স্পষ্ট করেছেন, ইউপিএ সরকার হলে বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী অথবা তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে তার আপত্তি নেই। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট