ভারতের রাজনীতির গতিধারা

87

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমপর্যায়ে পৌঁছেছে। কাশ্মির ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার পারদ প্রতিনিয়ত উর্ধ্বমুখী হচ্ছে। ভারত বাংলাদেশের অত্যন্ত নিকটতম প্রতিবেশি হিসেবে একটি বিশাল শক্তিশালি দেশ। কাজেই ভারতের ভাল মন্দ বাংলাদেশকে স্পর্শ করতেই পারে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আপাতত সুস্থির হলেও প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যবসায় বেশ কিছুটা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়নমুখী বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয়ের খাতে আর্থিক অসঙ্গতি দৃষ্টিকট‚ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্র, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য যা হোক আজকে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। এ কথা ঠিক, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে দু’জন নেতার রাজনৈতিক প্রভাব বা জনপ্রিয়তা নজিরবিহীন বলে প্রতীয়মান। প্রথমত মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত যদিও তাঁকে কোন অজ্ঞাত কারণে আওতাতীয়র হাতে গুলিতে নিহত হতে হয়। মূলত বিভিন্ন জাত, ধর্ম ও ধর্মীয় বৈষম্যের উর্ধ্বে উঠে ঐক্যের ভিত্তিতে অখÐ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কামনা করেছিলেন। ভারতবর্ষে তার মতো জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেনি আর। তারপরও তিনি তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কংগ্রেসের কিছু রাজনৈতিক নেতার বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক আচরণের কারণে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে ১৯০৬ সালে ভারতীয় মুসলমানের স্বার্থ রক্ষার্থে পৃথক রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ স্বতন্ত্রভাবে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। তীব্র আন্দোলনের ফলে উপনিবেশবাী ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। একই সাথে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ভারত ও পাকিস্তান। পরে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মতো জনপ্রিয়, বিচক্ষণ নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়।
এ কারণে আঞ্চলিকতার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ফলে ভারতের জাতীয় পর্যায়ের বড় দল হলেও কংগ্রেস সরকার গঠনে আঞ্চলিক দলগুলোর ওপর ক্রমান্বয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এদিকে ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টির উঠে আসা হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রসারের প্রেক্ষপটে ব্যাপকতা লাভ করে। কংগ্রেসর প্রচারিত ধর্মনিরপেক্ষবাদী আদর্শ বিজেপির সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী আদর্শের কাছে পশ্চাৎপসারণ করতে থাকে। কয়েক বছর আগে বিজেপির নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদির ম্যাজিকের মত আবির্ভাবের পর ভারতীয় জাতীয় রাজনীতি চরমভাবে হিন্দুত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে জাথীয়তাবাদের নামে। এ কথা বলা যায় যে, মহাত্মা গান্ধীর পরে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে মোদির মতো এত বেশি জনপ্রিয়তা আর কেউ অর্জন করতে পারেননি। বিগত সময়ে ভারতের রাজনীতিতে যে সব শক্তিশালী নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই আঞ্চলিক নেতা। মারাঠাদের অতীত নেতা শিবাজী, শিখ সম্প্রদায়ের বিরাট নেতা রনজিত সিংহ ছিলেন আঞ্চলিক নেতা। অপরদিকে নরেন্দ্র মোদি কূটকৌশল ও দুরদর্শিতার মাধ্যমে আঞ্চকি পর্যায় থেকে উঠে এসে ভঅরতের জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ করে ফেল্লেন তা রীতিমত রাজনীতি গবেষক বা বিশ্লেষকদের নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি রামমন্দির নির্মাণ এবং অযোধ্যার ও গুজরাটের সাম্প্রদায়িক হত্যাকাÐের ইস্যুকে নির্বাচনী প্রচারণায় প্রাধান্য দিয়েছিলেন। হিন্দুত্ব উসকে দিতে তার কৌশল কাজে লেগেছিল। ফলে বিজেপি নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করেছিল এবং নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখানে রাজনীতির ধর্ম এক বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের বাংলাদেশে যারা ধর্মকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদ রাখতে চায়, আমার মনে হয় তাদের এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করার সময় এসেছে। যাক আমি রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে বিতর্ক আর বাড়াতে চাই না। পরে ১৯১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে মোদি আবার শক্তিশালী ভারত গঠন ও হিন্দুত্ববাদ ইস্যুকে কৌশলগতভাবে সামনে নিয়ে আসেন। নির্বাচন সামনে রেখে ভারত ও পাকিস্তানের সাময়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এই প্রেক্ষাপটে মোদি মহলের প্রচারণায় প্রভাবিত জনসাধারণ। শক্তিশালী ভারত গঠনের লক্ষ্যে মাদির প্রতি সমর্থন দেয়। নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাািজত করে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বারের ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন। ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠা কাশ্মির রাজ্যের বিশেষ মর্যাদার ৩৭০ ও ৩৫ এর ‘ক; ধারা বাতিল করে দিয়েছেন। শাসনাধীনে আনয়ন করেন। ভারতের উপজাতীয় জনগোষ্ঠি অধ্যুষতি রাজ্যগুলোতে সাংবিধানিক ৩৭১ ধারার শাসন চালু আছে। সে সব রাজ্য বিশেষতহ মিজোরাম, অরুণাচরসহ অনেক রাজ্যে কাশ্মিরের সাংবিধানিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়। তারা তাদের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার হরনের শঙ্কায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। এই রাজ্যগুলোর আসা অজনের লক্ষ্যে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, সংবিধানের ৩৭১ ধারা সেখানে বাতিল করা হবে না। উপরন্তু তিনি ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির তালিকা প্রনয়নের মাধ্যমে রাজ্যগুলি থেকে বহিরাগতদের বিতাড়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজেপি উপজাতীয়দের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন মূলত মুসলিমদের হঠানোর মধ্য দিয়ে। অনেক ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষী মানুষের বাস ভারতে, নানা কারণে এক প্রদেশের লোক অন্য প্রদেশের গমণাগমন করে থাকে। সর্বোপরি সপ্ত কন্যা খ্যাত উত্তরপূর্ব ভারতের পার্বত্য রাজ্যগুলোতে আদিবাসী হিন্দু মুসলি সংখ্যা কম। আগে সেখানে জনসংখ্যার হার ছিল কম। সে কারণে ভারতের বিভিন্ন াজ্যে থেকে অনেকেই এ সব রাজ্েয চাকরি ও ব্যবসার কারণে বসতি স্থাপন করেছেন। কাশ্মির ইস্যুকে কেন্দ্র করে উপজাতীয় রাজ্যগুলোর রাজনীতি উত্তপ্ত হওয়ায় বিজেপি ওইসব রাজ্যে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নামে। জনসংখ্যার তালিকা প্রকাশ করার বিতর্কিত প্রকিয়া শুরু করেছে। মূলত রাজ্যগুলোতে নিজস্ব ভোট ব্যাংক তৈরির এবং হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিজেপি সরকার এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বর্তমান ভারতের রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিধারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে চলেছে। ভারতের সংবিধান রচয়িতা দলিত নেতা ড. বি আর আম্বেদকর দলিতদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিলেন। তবে গান্ধী সুকৌশলে দলিত সম্প্রদায়কে ‘হরিজন’ আখ্যা দিয়ে তাদের রাজনৈতিক দাবিকে অবদমিত করেছিলেন। আগামী দিনে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে। ধর্মনিপেক্ষতার আদর্শ যত দুর্বল হবে, হিন্দুত্ববাদী তত বেগবান হবে। এ প্রক্রিয়ায় মুসলমান ও দলিতদের সাথে কথিত জাতীয়তাবাদীদের দূরত্ব বৃদ্ধি পাবে। অথচ দলিত ও মুসলমান জনসংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক তদুপরি উঃ পশ্চিম ভারতের শিখেরা একাধিকবার স্বাধিকার আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছে। সে কারণে ভারতের হিন্দুত্ববাদী উগ্র চেতনা দেশটির জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে তা অনিশ্চিত। ভারতের গণতন্ত্রের হাল দিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতি অমর্ত্য সেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পত্রিকায় দেয়া তার সাক্ষাতকার নয়া দিগন্তসহ ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় (৯ অক্টোবর) প্রকাশিত হয়েছে। ‘অমর্ত্য সেন বলেছেন, গণতন্ত্র মানে আলোচনার ভিত্তিতে চলা সরকার, ভোট যেভাবেই গণনা করো, আলোচনাকে ভয়ের বস্তু করে তুললে তুমি গণতন্ত্র পাবে না।’ তার আক্ষেপ, ভারতে এখন একচেটিয়া কট্টর বা উগ্র হিন্দুত্বের দাপট চলছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে তার মূল্যায়ন হলে ‘বহুদ ধর্ম ও বহু জাতির দেশ ভারতকে বোঝার মতো মনের প্রসারতা নেই মোদি’র। ভারতের মতো এই বৈচিত্র্যের অধিকারী দেশ আর দেখি নি। আমাদের সবার উচিত হবে এই বৈচিত্য রক্ষা করা। যুদ্ধ কোনো কিছুর সমাধান নয়। যুদ্ধ বাধলে খুব সহজ, নিমিষে সব কিছু ধ্বংস করে দেয়া যায়। পারমানবিক যুদ্ধ বাধিয়ে আমরা সবাই মারা গেলে তো কারোরই লাভ হবে না। মানব সভ্যতার কল্যাণের জন্য হিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতি পরিহার করতে হবে। শান্তির এই বার্তা ভারতের কাছে পৌঁছাতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট